ঢাকামঙ্গলবার , ৮ মার্চ ২০২২
  • অন্যান্য

কর্ণাটকে হিজাবে বিতর্ক: বেড়েছে সাম্প্রদায়িকতা

মার্চ ৮, ২০২২ ৬:৪৪ অপরাহ্ণ । ২৬৪ জন

ভারতের বৃহত্তম রাজ্য উত্তর প্রদেশে প্রাদেশিক বা রাজ্য নির্বাচন শুরু হয়ে গিয়েছে। চলছে মাস খানেকের মত। সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চলছে, চলমান এই নির্বাচনের মাধ্যমে ভারতের ক্ষমতাসীন সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক দল ভারতীয় জনতা পার্টি (বি জে পি) কে লালকার্ড দেখানোর। যেহেতু উত্তর প্রদেশ ভারতের বৃহত্তম রাজ্য- তাই ঐ রাজ্য থেকে দলটিকে পরাজিত করতে পারলে আগামী লোকসভা নির্বাচনে দিল্লীর মসনদ থেকে নরেন্দ্র মোদী ও তার দলকে অপসারণ করা সম্ভব হবে-এমন প্রত্যাশা সে দেশের অসাম্প্রদায়িক চেনায় উদ্বুদ্ধ কোটি কোটি মানুষের।

সহজ হিসেবে এ কথা বলে দেওয়া যায়, সাম্প্রদায়িক শক্তিকে পরাজিত করে অসাম্প্রদায়িক ধর্মনিরপেক্ষ শক্তি ক্ষমতাসীন হতে পারলে সকল ধর্মের সাম্প্রদায়িক-অর্থাৎ ধর্মান্ধ শক্তিগুলির বিপদে পড়ার কথা এবং সবচেয়ে লাভবান সম্প্রদায়গুলি-ভারতের ক্ষেত্রে তা হচ্ছে মূলত: মুসলিম সম্প্রদায়ভূক্ত কোটি কোটি মানুষ।

ভারতের সিংহাসনটি ধরে রাখার জন্য উত্তর প্রদেশেল চলমান নির্বাচনের মুহুর্তে একটি সাম্প্রদায়িক আবহ ভারত জুড়ে উসকে দেওয়ার কৌশল বিজেপির পক্ষে নেওয়া সম্ভব। এবং সে কারণেই সাম্প্রদায়িকতার শিকল ভারতের মুসলিম ও অন্যান্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের পক্ষে বিজেপির উসকানির ফাঁদে কোনভাবেই পা দেওয়া হবে তাঁদের জন্যে আত্মঘাতি।

এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ বা ভারতীয় রাজনীতির গণমুখী পরিবর্তনের সন্ধিক্ষণে ঠিকই উসকানী দেওয়ার সুযোগ পেয়ে গেল গেরুয়া বসনধারী বিজেপি বাহিনসী এবং পেরেও উঠলো মুসলিম নারী (কর্ণাটক রাজ্যে) মুসকাল খান নাম্নী এক মুসলিম যুবতীর হিজার পরে কলেজে যাবার বিষয়টিকে কেন্দ্র করে। তারা কলেজের প্রবেশ পথে মুসকানকে আটকে তিদে উদ্যেত হয়ে উস্কানী বৃদ্ধির নিমিত্তে “জয় শ্রীরাম” বলে শ্লোগান দিয়ে উঠলে আক্রান্ত হওয়া আশংকায় প্রাণভয়ে “আল্লাহু আকবর” বলে চীৎকার করে ওঠে। পরিস্থিতি সামাল দিতে কলেজ কর্তৃপক্ষ মাসকিনকে সরিয়ে নিয়ে নিরাপত্তা দেন।

কিন্তু ঘটনার এখানেই ইতি ঘটলো না। বরং সাম্প্রদায়িক উগ্রতা ভারত জুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে। উভয় সম্প্রদায়ের সাম্প্রদায়িক শক্তি এই অস্বাভাবিক পরিস্থিতির সুযোগ নিতে বিশেষভাবে তৎপর হয়ে উঠেছে। উত্তরপ্রদেশসহ ভারতের পাঁচটি প্রদেশে চলমান নির্বাচনে বিজেপি এই সাম্প্রদায়িক আবহকে কাজে লাগাতে তৎপর হয়ে ওঠার একটা অস্ত্র হাতে পেয়েছে।

কী অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে ভারতজুড়ে?
বাংলাদেশের একটি জনপ্রিয় দৈনিকে তার ১০ ফেব্রুয়ারি তারিখে প্রকাশিত সংখ্যায় “কর্ণাটকে হিজাব বিতর্ক রাজ্যে রাজ্যে ছড়িয়ে পড়েছে বিক্ষোভ” শিরোনামে প্রকাশিত খবরে জানিয়েছে: “ভারতের কর্ণাটক রাজ্যে হিজাব নিষিদ্ধের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে প্রদেশটির রাজধানী বেঙ্গালুড়র শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলির আশপাশে সমাবেশ ও বিক্ষোভ ১৫ দিনের জন্যে নিষিদ্ধ করেছে কর্তৃপক্ষ। বিষয়টি গড়িয়েছে উচ্চ আদালতেও। হাইকোর্ট হিজাবের উপর কড়াকড়ি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন।

অপরদিকে, গত মঙ্গলবার ৭ ফেব্রুয়ারি মুসকান খান নামের এক তরুণী তার কলেজে উগ্র হিন্দুদের বাধার মুখে “আল্লা হু আকবর” বলে প্রতিবাদ করে অসীম সাহসের পরিচয় দেওয়ায় প্রসংসিত হচ্ছেত। ভারত সীমান্ত ছড়িয়ে তার প্রশংসা ছড়িয়ে পড়েছে সারা বিশ্বের অন্তর্জালে। ভারতের একটি মুসলিম সংগঠন তাকে পাঁচ লাখ রূপী পুরস্কারের ঘোষণা দিয়েছে।

মুসকানের ঘটনায় হিন্দুত্ববাদী বিজেপি শাসিত কর্ণাটকে সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে নিপীড়ন সারা বিশ্বের নজর কেড়েছে। নোবেল জয়ী মালালা ইউসুফজাই হিসাব নিষিদ্ধের নিন্দা করেছেন। তার সঙ্গে সুর মিলিয়েছেন কংগ্রেস নেত্রী প্রিয়াঙ্গা গান্ধীসহ অনেকেই।

ভিডিও ফুটেজে দেখা যায় মুসকান ঐ দিন বোরকা ও হিজাব পরে স্কুটি চালিয়ে তার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ঢুকতেই বাধার মুখে পড়েন। তার উদ্দেশে একদল উন্মাত্ত তরুণ গেরুয়া স্কাফ নেড়ে ‘জয় শ্রীরাম’ বলে চীৎকার করে। তারা মুসকানের দিকে এগিয়ে আসে। মেয়েটি এই বিপজ্জনক পরিস্থিতি থেকে দূরে সরে যেতে যেতে “আল্লাহু আকবর” বলে পাল্টা জবাব দেয়। পরে মেয়েটিকে কর্তৃপক্ষ নিরাপদে সরিয়ে নেয়। তবে কর্ণাটকের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষামন্ত্রী বিসি নাগেল উল্টো ঐ তরুণীকেই দায়ী করেছেন এবং উগ্র হিন্দুরেদ উসকানী দিয়েছেন।

কর্ণাটকের কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কয়েকদিন ধরেই হিজাব পরার উপর অলিখিত নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। তবে মুসকানের ভিডিও ছড়িয়ে পড়লে তা সারা বিশ্বের নজর কাড়ে। এ দিনই পাঁচ মুসলিম শিক্ষার্থী কর্ণাটক হাইকোর্টের হিজাব পরার সাংবিধানিক অধিকার রক্ষায় আবেদন জানান।

বুধবার হাইকোর্টের বিচারপতি কৃষ্ণ দীক্ষিত হিজাবের উপর কড়াকড়িতে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে মামলাটির গুরুত্ব বিবেচনা করে তা বিচারের জন্য বৃহত্তর বেে শুনানীর আদেশ দানের জন্য প্রধান বিচারপ্রতির হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন।

কর্ণাটক পরিস্থিতির অবনতি ঠেকাতে রাজ্যের দেবাঙ্গির, শিকাগো এবং বালাকার্টের মত উত্তেজনা প্রবণ এলকায় ১৪৪ ধারা জারী করা হয়েছে। এই রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে বিক্ষোভের আঁচ ছড়িয়ে পড়েছে মধ্যপ্রদেশ এবং পুদুচেরিতেও। দিল্লী বিশ্ববিদ্যালয়ের নর্থ ক্যাম্পাসে স্টুডেন্টস এসোসিয়েশন নামের একটি ছাত্র সংগঠন। এতে বহু শিক্ষার্থী অংশ নেন। এর মধ্যে অনেক নারী শিক্ষার্থী হিজাব নিয়ে বিক্ষোভ করেন। এ সময় কর্ণাটকের আন্দোলনকারীদের সমর্থনে তারা বিভিন্ন ব্যানার বহন করেন। হিজাব নিষিদ্ধের বিরুদ্ধে নয়াদিল্লীতে বিক্ষোভ করেছে মুসলিম স্টুডেন্টস ফেডারেশন।

নোবেলজয়ী মালালা ইউসুফকাই এক ট্যুইটারে লিখেছেন, ‘হিজাব পরে মেয়েদের স্কুলে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না। এটা ভয়ংকর ব্যাপার।’ ভারতের রাজনীতিকদের কোনঠাসা করার চেষ্টা এবার বন্ধ করুন আপনারা’

হিজাবের উপর নিষেধাজ্ঞার সমালোচনা করে কংগ্রেস নেত্রী প্রিয়াংকা গান্ধী বলেছেন, বিকিনি, ঘোমটা, জিনস কিংবা হিজাব নারী কী পরতে চান সে সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার তারই। এই অধিকার ভারতীয় সংবিধানের মাধ্যমে নিশ্চিত করা হয়েছে। নারীদের হয়রানি বন্ধ করুন।

উল্লেখ্য, মুসকানকে ভারতের মুসলিমদের নেতৃস্থানীয় সংগঠন জমিয়ত উলামায়ে হিন্দ পাঁচ লাখ টাকা পুরস্কারের ঘোষণা দিয়েছে। সম্প্রতি কর্ণাটক রাজ্যের উদুপি জেলার একটি সরকারি কলেজের কর্তৃপক্ষ শিক্ষার্থীদের ইউনিফর্ম সংক্রান্ত কিছু বিধি জারী করে। এতে বলা হয়, হিজাব পরে ক্লাস করা যাবে না কারণ তা বৈষম্য সৃষ্টিকারী। কর্তৃপক্ষের নির্দেশ অনুযায়ী ছাত্রীরা ‘স্কাফ’ পরতে পারবে তবে তার রং হতে হবে ওড়নার রং এর সাথে মানানসই এই নিয়মের প্রতিবাদ জানিয়েছে মুসলিম ছাত্রীরা। এ বিতর্ক ছড়িয়ে পড়েছে রাজ্যের অন্যত্রও। রাজ্যের কোথাও হিজাবে বিরুদ্ধে হিন্দু ছাত্রদের একাংশকে গেরুয়া চাদর ও ওড়না পরতে দেখা যায়। দুই ধর্মের শিক্ষার্থীদের মধ্যে বঢসাও হয় কোথাও কোথাও। হিজাব বিতর্কের জেরে মঙগলবার কর্ণাটক রাজ্যের সকল স্কুল কলেজ তিন দিন বন্ধ রাখার সিদ্ধান্তও নিয়েছেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী বাসবরাক বোম্নাই স্বয়ং।

মুসকানের ঘটনাটি ভারতের গণমাধ্যমের পাশাপাশি বিবিসি, আলজাজিরা সহ আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমেও গুরুত্ব পেয়েছে। সাংবাদিদের মুসকান বলেছেন, “আমি ভয় পাইনি”। তিনি বলেন, কলেজে যারা তাকে হেনস্থা করেছে তাদের বেশীরভাগই বহিরাগত। তবে কলেজের অধ্যক্ষ, প্রভাষক এবং সহপাঠিরা তাকে সমর্থন জানিয়েছেন। পরদিন তিনি সাংবাদিকদেরকে জানান ডিপার্টমেন্টে একটা এসাইনমেন্ট জমা দেওয়ার জন্য তিনি কলেজে গিয়েছিলেন। তিনি বলেন, বোরকা পড়ে কলেজে যাওয়ার কারণে একদল শিক্ষার্থী আমাকে গেটে আটকানোর চেষ্ট করে তারা বলেছি-কলেজে ঢুকতে হলে বোরকা খুলতে হবে, না হয় ফিরে যেতে হবে। আমি সেটির প্রতিবাদ করেছি।

মুসকান আরও বলেন, “কট্টরপন্থী ওই হিজাব বিরোধিরা একই কাজ আমার অন্য সহপাঠিদের সঙ্গে করেছে। আমি ওই গ্রুপকে পাল্টা প্রশ্ন করি, কলেজে না প্রবেশ করে আমি কেন বাড়ি ফিরে যাব? এর পর তাদের কয়েকজন আমার কাছে আসে এবং কানের কাছে জোরে “জয় শ্রীরাম” বলে চিৎকার করে। আমি সামনে এগাতে থাকলে তারা আমার পিছু পিছু আসতে থাকে এবং আমাকে অবশ্যই বোরকা খুলতে হবে বলে চীৎকার করতে থাকে। কিন্তু আমি আমার অবস্থানেই।

মুসকান বলেন, ‘আমি কোন ভয় পাইনি। আমি কোন ভয় ছাড়াই আল্লাহু আকবর’ শ্লোগান দিয়েছি। তাদের ‘জয় শ্রীরাম’ এবং আমার ‘আল্লাহু আকবর শ্লোগানের মধ্যে ভুল কিছু নেই। আমি এখন আদালতের রায়ের জন্য অপেক্ষা করছি। আদালত যে রায় দেবেন আমি মেনে নেব’

তিনি বলেন, ‘হিজাব বিরোধীদের হাত থেকে তাকে রক্ষায় কর্তৃপক্ষ সহায়তা করেছেন।’ মুশতাকের ভাষায় ‘যার যার ধর্মীয় রীতি পালনের ও অনুসরণ করার অধিকার সব ধর্মেই আছে। আমি আমার ধর্মীয় রীতি পালন করবো। মুসকান কর্ণাটক রাজ্যের পিইএস কলেজ অব আর্টস, সায়েন্স এন্ড কমার্সের বাণিজ্য বিভাগের ছাত্রী। কলেজটি রাজ্যের মান্দিয়া জেলায় অবস্থিত।

এই সমগ্র ঘটনা দেখার পরেও এত বেশী সাম্প্রদায়িক উত্তেজনার খবর দেশে বিদেশে ছড়িয়ে পড়ার পরেও দিল্লীর মসনদে বসে থাকা নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বাধীন বিজেপি দলীয় কেন্দ্রীয় সরকার দিব্যি নিশ্চুপ বসে আছে। ফলে এটা স্পষ্ট যে ওই কেন্দ্রীয় সরকারও হিজাব বিরোধী ধর্মান্থ হিন্দু উগ্রবাদীদের পক্ষেই পরোক্ষ সমর্থন যুগিয়েছে।

ভারতের সংবিধান শুধুমাত্র ধর্মনিরপেক্ষ তাই নয়। সংবিধানে স্বীকৃত রয়েছে ধর্মীয় স্বাধীনতা এবং মানবাধিকারও। কোন ধর্মে বিশ্বাসী মেয়ে বা ছেলেরা কী পোষাক কখন পরবেন তা তাদের মানবাধীকারের অধীন। এটা ব্যক্তিস্বাধীনতার বিষয়ও বটে। মুসলিম মেয়েরাও সকলে হিজাব পরেন না। মুসলিম ছেলেরাও সর্বদা লুঙ্গি বা পায়জামা পরেন না-হিন্দু ছেলেরাও সকলে সর্বদা ধুতি পরেন না। হিন্দু মুসলিম নির্বিশেষে ছেলে-মেয়ে উভয়ের অনেকেই প্যান্ট-সার্ট পরতে পছন্দ করেন এবং পরেনও। এটা টাইট কি লুজ তা যিনি পরবেন তিনিই নির্ধারণ করবেন।

মূল কথা হলো একটা ইস্যু সৃষ্টি করে ভারত ব্যাপী নতুন করে সাম্প্রদায়িকতা উস্কে দিয়ে ক্ষমতার গদী আর এক দফা বাড়ানো। বিজেপি সেই চেষ্টাই করছে সে কারণেই তারা সাম্প্রদায়িকতার বিষাক্ত পরিবেশ রচনা করছে।সাহসী মেয়ে মুসকান এর প্রতিবাদ জানিয়েছেন। তাকে অভিনন্দন।

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। গ্রীনসিটি ২৪ ডটকম এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)

চ্যানেল আই