ঢাকাবুধবার , ৯ মার্চ ২০২২
  • অন্যান্য

আবহাওয়া নিয়ে আর হাসিঠাট্টা নয়! প্রায় নির্ভুল তথ্য জানাতে পারে এখন আবহাওয়া বিভাগ

মার্চ ৯, ২০২২ ১২:২০ অপরাহ্ণ । ১১৮ জন

একসময় দেশের আবহাওয়া বিভাগের দেওয়া পূর্বাভাস নিয়ে হাসি-ঠাট্টা হতো নিয়মিতই। কিন্তু এখন আর সেই পরিস্থিতি নেই। আগের চেয়ে অনেক বেশি নির্ভুল পূর্বাভাস দিতে পারে বাংলাদেশের আবহাওয়া বিভাগ। কীভাবে সম্ভব হলো এই পরিবর্তন?

আবহাওয়ার পূর্বাভাস। বাংলাদেশে টিভিতে, রেডিওতে এই পূর্বাভাস দেওয়ার কাজটি যারা করেন, তারা প্রায়ই হাসির খোরাক হন। প্রায়ই লোকে হাসাহাসি করে বলে, আবহাওয়া বিভাগ যে পূর্বাভাস দেবে, তার উল্টোটা ধরে নিলেই সঠিক পূর্বাভাস পাওয়া যাবে।

কিন্তু এখন আর সেই পরিস্থিতি নেই। আগের চেয়ে অনেক বেশি নির্ভুল পূর্বাভাস দিতে পারে বাংলাদেশের আবহাওয়া বিভাগ। অনেক ঝড়, সাইক্লোনের পূর্বাভাস সঠিকভাবে দিয়ে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কমাতে ভূমিকা রেখেছেন দেশের আবহাওয়াবিদেরা।

আবহাওয়াবিদ হিসেবে কর্মরত এসএম কামরুল হাসান। তিনিও এই চাকরিতে যোগ দেওয়ার আগে আবহাওয়ার পূর্বাভাস নিয়ে হাসাহাসি করতেন। কিন্তু পরে দেখলেন ভিন্ন অভিজ্ঞতা।

কামরুলের ভাষায়, ‘এখানে কাজ করতে এসে দেখি শুধু হেসে উড়িয়ে দেওয়ার ব্যাপার নয় এটি। সরকারি চাকরি করার ইচ্ছা আমার ছিল না, ভাবতাম নিজের চিন্তা বিস্তৃত করা যায় তেমন কোথাও কাজ করব যেমন গবেষণা। পড়তাম রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিজ্ঞান। পরে ইন্টারভিউ দিয়ে চাকরি হয়ে গেল। বাসা থেকেও বলল, যোগ দাও।

‘আর পরে কাজ করতে গিয়ে দেখি আবহাওয়া বিষয়ক অধ্যয়ন একটা দারুণ ব্যাপার। মানুষের কল্যাণে তো আসাই যায়, প্রতিদিন নিতে হয় চ্যালেঞ্জ। হ্যাঁ, আমরাও শুনতাম আবহাওয়া দপ্তর বলছে, কাল বৃষ্টি হবে। হেসে বলতাম, কাল দেখে নিও কড়া রোদ থাকবে। এমনটা আর নেই আসলে। প্রযুক্তির উন্নয়ন একটা বড় ব্যাপার, আমরাও অভিজ্ঞ হয়েছি। দক্ষতা বেড়েছে আমাদের।’

আরেক আবহাওয়াবিদ একেএম নাজমুল হক জানালেন চলতি শতকের আগ পর্যন্ত মানুষ সেভাবে খবর শুনত না বা পেত না। এখন হাতে হাতে মোবাইল। এই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের সময়ে প্রতিবেলার খবর পাচ্ছে মানুষ। জানতেও পারছে পুরোটা। আগে হয়তো অর্ধেক শুনত, বাকিটা শুনত না। একদিন শুনত, অন্যদিন খেয়াল করত না।

নাজমুলের ভাষ্যে, ‘যেমন ধরুন, ঢাকা বিভাগে ১৩টি জেলা আছে। আমরা পূর্বাভাস দিলাম, কাল ঢাকার দু-এক জায়গায় বৃষ্টি হতে পারে। এক্ষেত্রে সাধারণত আমরা ২৫ ভাগ কাভারেজ এলাকা বোঝাই। সেক্ষেত্রে গাজীপুর বা মানিকগঞ্জে বৃষ্টি হলো, কিন্তু টাঙ্গাইলে হলো না। তখন টাঙ্গাইলের লোক বলে, আমরা ঠিক বলিনি। সর্বোপরি আমরা এখন কনভেনশনাল আবহাওয়া অধ্যয়ন থেকে ডিজিটাল অধ্যয়নে পৌছে গেছি ।’

কামরুল হাসান ১৯৯৬ সালে আবহাওয়া দপ্তরে যোগ দেন। গোড়াতে তিনিও ছিলেন ফোরকাস্টার। এখন তৈরি করেন পরিকল্পনা, বাস্তবায়নেও ভূমিকা রাখেন। আর এর জন্য তাকে প্রতিনিয়তই পড়াশোনা ও গবেষণার সঙ্গে যুক্ত থাকতে হয়।

একেএম নাজমুল হকও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়েরই ছাত্র ছিলেন। ২০১২ সালে দপ্তরে যোগ দিয়েছেন তিনি। বলছিলেন, ‘যোগ দেওয়ার পরের বছরের পুরোটা ছিল ট্রেনিং পিরিয়ড। ওই ৩৬৫ দিনে আমরা কোনো ফুরসত পাইনি। একদিনও ছুটি ছিল না। ওই বছরটাই আমাদের ভিত্তি গড়ে দিয়েছে।’

সাধারণত পদার্থবিজ্ঞান, ফলিত পদার্থবিজ্ঞান বা পরিসংখ্যানের ছাত্ররা আবহাওয়া বিভাগের কাজে ভালো করেন।

একটি ওয়েদার চার্ট

নাজমুল হক দিন শুরু করেন আবহাওয়ার বার্তা শুনে। সেইসঙ্গে আগের দিন যে প্রেডিকশন করেছিলেন, তা মিলিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেন। সাধারণত দিনে দুবার আবহাওয়া বিভাগ পূর্বাভাস দিয়ে থাকে—সকাল ৯টায় ও বিকাল ৫টায়। প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় প্রচারের জন্য, ভিভিআইপি দপ্তরের জন্য, এয়ারপোর্টের জন্য, কৃষি দপ্তরের জন্য বা নদীবন্দরগুলোর জন্য আবহাওয়া বিভাগ পূর্বাভাস প্রস্তুত করে থাকে। তবে সাগরে কোনো ওয়েদার ফর্ম করলে আবহাওয়া বিভাগ ৪ বার পূর্বাভাস দেয়।

নাজমুল হক বলেন, ‘আবহাওয়ার তথ্য জানার জন্য আপনি ১ টাকা খরচ করলে ১৩ টাকা ফেরত পাবেন। এটা বৈশ্বিক গবেষণা থেকে প্রমাণিত।’

কনভেনশনাল ও ডিজিটাল

কনভেনশনাল, অর্থাৎ সনাতন মেথড হলো চার্ট (সারফেস ও আপার লেয়ার) মেলানো। বাতাসের গতিবিধি বা প্যাটার্ন, আর্দ্রতা, বায়ুর চাপ, দিনের তাপমাত্রা, পানির বাষ্পায়ন ইত্যাদির সঙ্গে জলবায়ুর ইতিহাস মিলিয়ে চার্টগুলো পূরণ করা হয়। তা থেকে প্রাপ্ত তথ্যগুলো বিশ্লেষণ করে আবহাওয়ার পূর্বাভাস দেওয়া হয় বা হতো। রাডার বা স্যাটেলাইট ইমেজের সহায়তা পাওয়া যায় কেবল জরুরি সময়ে, অর্থাৎ যখন ওয়েদার ফর্ম (বাতাসে অতিরিক্ত চাপ তৈরি হওয়ার পর বা মেঘ ঘনীভূত হওয়ার পর) করে। মোটকথা, আগে একজন ফোরকাস্টার আগের চার্ট বা তারও আগের চার্ট নিজের মাথায় নিয়ে তবে পূর্বাভাস দিত। তার জন্য সৃজনশীলতা আর অভিজ্ঞতাও গুরুত্বপূর্ণ।

এখনকার ডিজিটাল যুগে এনডব্লিউপি (নিউমেরিক্যাল ওয়েদার প্রেডিকশন) নামের একটি কম্পিউটার মডেলের সহায়তা নেয়। এর উন্নতি হয়েছে গত দুই দশকে বেশি।

নাজমুল হক বলেন, ‘সাদেক স্যার (ড. সাদেকুল আলম) ও কামরুল হাসান স্যারের দীর্ঘ প্রচেষ্টায় এ গাণিতিক মডেল বাস্তবায়ন সম্ভব হয়েছে। সারা বিশ্বের কেন্দ্রীয় আবহাওয়া দপ্তর দিনে আটবার, মানে তিন ঘণ্টা পর পর সব স্টেশন থেকে আবহাওয়া বার্তা জোগাড় ও আপডেট করে। এনডব্লিউপি বৈশ্বিক ওই মডেলের সঙ্গে যুক্ত। ওখান থেকে প্রাপ্ত তথ্য, সঙ্গে স্যাটেলাইট ইমেজ বিশ্লেষণ করে আমরা পূর্বাভাস দিয়ে থাকি। ২৪ ঘণ্টার পূর্বাভাস এখন নিশ্চিত হয়েই দেওয়া যায়। তিন দিন বা সাত দিন পরের আবহাওয়া পরিস্থিতিও ধারণা করা যায়। এখন আমাদের পূর্বাভাস ৮৮ থেকে ৯০ শতাংশ পর্যন্ত অ্যাকুরেট (সঠিক) হয়। ১০০ ভাগ অ্যাকুরেসি পৃথিবীর কোথাও সম্ভব বলে মনে হয় না।’

কী ধরনের বিজ্ঞান এই আবহাওয়াবিদ্যা?

আবহাওয়াবিদ্যা কী ধরনের বিজ্ঞান? এ প্রশ্নের উত্ত শুনে নেওয়া যাক কামরুল হাসানের বয়ানে।

‘এটি অবজারভেশনাল সায়েন্স, মানে পর্যবেক্ষণমূলক বিজ্ঞান। একবার সম্ভবত ২০০২ সালের একটা ঘটনা মনে পড়ছে। মাঝখানে বলে নিই, এটা পর্যবেক্ষণমূলক বিজ্ঞান বলেই কিন্তু আবহাওয়াবিদকে অনেক সৃজনশীল হতে হয়। তাকে নিয়মিত অধ্যয়নের মধ্যে থাকতে হয় এবং বৈশ্বিক মানুষ হতে হয়।

‘ঘটনাটা দেখুন, আমি তখন ফোরকাস্টিং করতাম। সন্ধ্যার দিকে আমাকে রাডারের কর্মী (আইডিবি ভবনের ওপরে আবহাওয়া দপ্তরের ঢাকা কেন্দ্রের রাডার আছে) বলল, স্যার কিছু একটা ফর্ম করছে।

‘আমি জানতে চাইলাম, কতক্ষণের মধ্যে ঢাকায় ঘনীভূত হতে পারে বলে মনে করো। সে বলল, দুই থেকে আড়াই ঘণ্টা। আমি চার্ট নিয়ে বসলাম, সাড়ে ছয়টার দিকে ১ নম্বর সতর্কবার্তা দিলাম, তার এক ঘণ্টা পরই ২ নম্বর সতর্কবার্তা ঘোষণা করলাম। সদরঘাটকেও জানিয়ে দিয়েছিলাম। তারা লঞ্চ চলাচল বন্ধ করে দিয়েছিল।

‘তারপর রাত আটটায় রওনা হলাম বাড়ির পথে। রিকশায় করে যাচ্ছিলাম, শ্যামলীর দিকে গেছি আর তক্ষুণি প্রবল বাতাস বইল, আমি রিকশা থেকে নেমে পাশের একটা ভবনের নিচে আশ্রয় নিলাম আর ভাবলাম সতর্কবার্তা ২ নম্বর না দিলে হয়তো ক্ষতির পরিমাণ বাড়তো বিশেষ করে নৌপথে।

কামরুল হাসান বেশ কিছু ট্রেনিং কোর্সে অংশ নিয়েছেন পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে। ব্যাংককে এনডব্লিউপি প্রশিক্ষণ নিতে গিয়েছিলেন, ছয় মাসের জন্য। কিন্তু চার মাস না যেতেই দেশে ফিরতে চেয়ে বার্তা পাঠালের দপ্তর পরিচালককে। পরিচালক অবাক। ব্যাপারটি ছিল এমন—ভালো খাওয়া, ভালো থাকা, ভালো পরিবেশ ছেড়ে কেন আসতে চাওয়া?

কামরুল হাসান প্রত্যুত্তরে বলেছিলেন, ‘যা শিখতে এসেছিলাম, তা শেখা হয়ে গেছে; এখন যত তাড়াতাড়ি ইমপ্লিমেন্টেশনে যাওয়া যায় ততো ভালো।’

টিবিএস: দেশের যশস্বী কোনো আবহাওয়াবিদের নাম জানাতে পারেন? 

কামরুল হাসান বলেন: ‘অতি দুঃখের ব্যাপার তেমন কারুর নাম এখনো বলার সুযোগ আসেনি। আসলে এর জন্য একক কেউ দায়ী নয়। দেখুন, আবহাওয়া বিদ্যা পড়ার সুযোগ মাত্রই তৈরি হচ্ছে। ভারতের যেমন মৃত্যুঞ্জয় মহাপাত্র। মানুষটা সাইক্লোন ম্যান বলে খ্যাতি পেয়েছেন। একাত্তর সালে তার উড়িষ্যার বাড়ির ধারেই আছড়ে পড়ে ঘূর্ণিঝড় আর তাতে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। তখন সাইক্লোন ম্যানের বয়স ছিল মাত্র ছয়। সে থেকেই তিনি ঝড়টিকে দেখে নেওয়ার পণ করেছিলেন। লেগেই ছিলেন ঝড়ের পেছন পেছন।

‘ফলাফলে ১৯৯৯ সালের ফাইলিন ঘূর্ণিঝড়ের পরিষ্কার পূর্বাভাস দিতে পেরেছিলেন। তারপর তিতলি, ফণি, আইলা আর আম্পানেরও নির্ভুল গতিপথ বলে দিয়েছেন তিনি। এমন একজন মানুষ আমাদের দেশে এখনো পাইনি আমরা।’

টিবিএস: মেগা প্রজেক্টগুলো তৈরি হওয়ার আগে আবহাওয়া বিভাগের পরামর্শ নেওয়া হয়?

নাজমুল হক: মাতারবাড়ি প্রকল্পের কথা বলতে পারি। রাতে গিয়েও জাপানী প্রকৌশলীদের সঙ্গে মিটিং করেছি। তারা আমাদের কাছে ঢেউয়ের উচ্চতা, ঢেউয়ের গতি, দিক, বৃষ্টির পরিমাণ ইত্যাদি জানতে চেয়েছিলেন। আমরা তাদের পর্যাপ্ত তথ্য জোগান দিয়েছিলাম। নইলে হয়তো ভুল উচ্চতায় বাঁধ তৈরি হয়ে যেত যেটা ঢেউ থামাতে পারত না।

টিবিএস: ঢাকার মতো অসহ্য গরমের ও হাটু পানি জমে যাওয়া শহরকে সহনশীল করার জন্য আপনাদের পরামর্শ নেওয়া হয়েছে কখনো?

নাজমুল হক: এটা আমার জানা নেই। তবে শহর পরিকল্পনাকারী তো আগেই ভাববেন কোন কোন বিষয়গুলো সমস্যা তৈরি করবে। তখন পরিকল্পনাকারী যাদেরকে প্রয়োজন তাদেরকে নিয়ে বসবেন ভাবতে। সবাই মিলে ভাবলে সমস্যা নিরসনের উপায় আগেই বেরিয়ে আসবে। আমার মনে হয় কিছু সরকারি প্রকল্পে আমাদের পরামর্শ চাওয়া হয়েছে এবং আমরা প্রয়োজনীয় সহযোগিতাও দিয়েছি। আর সাধারণ মানুষেরও কিন্তু ভূমিকা রাখার সুযোগ আছে। আপনি একটি চিপসের প্যাকেট কোথায় ফেলছেন তা কি ভেবে দেখছেন? সেটা শেষে গিয়ে ওই স্যুয়ারেজ লাইনের মুখেই জড়ো হবে। শহরকে বাসযোগ্য করতে নাগরিককেও ভূমিকা রাখতে হবে।

কামরুল হাসান: আমার মনে হয় একটা ভালো নগর তৈরিতে আবহাওয়াবিদ ভালো ভূমিকা রাখতে পারেন। বিশেষ করে এখন যখন পরিবেশবান্ধব জীবনযাপনের কথা ভাবা হচ্ছে, তখন আসলেই কতটা বৃষ্টির পানি মৌসুমে ধরে রাখবে শহরবাসী, তা জেনে নিতে পারেন আবহাওয়া দপ্তর থেকে। অথবা তাপমাত্রা কবে অসহনীয় মাত্রায় উঠবে বা কবে অনেক বৃষ্টি হবে, তা জেনে পোশাক-আশাক, খাবার, পথচলা নির্ধারণ করতে পারেন। জলবায়ুর ইতিহাস জানলে কিন্তু ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাটের নকশাও আরামদায়ক করা সম্ভব। জাপান তো ভূমিকম্পের কথা মাথায় রেখেই শহর পরিকল্পনা করে, তাই না?

টিবিএস: ২০০১ সালে পূর্বাভাস কত ভাগ সঠিক ছিল?

কামরুল হাসান: ২৪ ঘণ্টার ফোরকাস্ট তখনও ভালো ছিল। এখন তিন দিন আগের পূর্বাভাসও মিলছে।

টিবিএস: কীসের পূর্বাভাস দেওয়া কঠিন?

কামরুল হাসান: কালবৈশাখী ঝড় আর টর্নেডোর। এগুলোর পূর্বাভাস দেওয়া কেবল কঠিন নয়, দুরূহ। আপনি সকালেও দেখবেন কিছু নেই, কিন্তু দুপুরের আগেই দেখলেন কিছু ফর্ম করছে, তারপরই ঝড়ো হাওয়া বইতে শুরু করে—আর হয়তো অল্প সময়ের মধ্যে লন্ডভন্ডও করে দিয়ে গেল। আপনি দেখতে পাবেন কী ঘটছে কিন্তু পূর্বাভাস দেওয়ার সময় পাবেন না।

টিবিএস: কবে থেকে এনডব্লিউপি বাস্তবায়নের কাজ শুরু হলো?

কামরুল হাসান: ২০১০ সাল থেকে। তবে সুফল পেতে কিছু সময় লেগেছে।

টিবিএস: সাফল্যের উদাহরণ কি দেওয়া যাবে?

নাজমুল হক: ১৯৭০ সালের ঘূর্ণিঝড়ে সরকারি ঘোষণামতে ৩ লক্ষ মানুষ মারা গেছে। ১৯৯১ সালে মারা গেছে দেড় লক্ষ প্রায়। ২০০৭ সালের সিডরে মারা গেছে ২০০০। তারপরে যে ঝড়গুলো হয়েছে হয়তো একই মাত্রার নয়, তবু মৃত্যুর হার নগন্য ধরা যাবে, সম্ভবত ১৩-২০।

টিবিএস: এর জন্য কার কৃতিত্ব বেশি?

নাজমুল হক: আবহাওয়া দপ্তরের কৃতিত্ব অনেকখানি। আর সাইক্লোন ম্যানেজমেন্ট কার্যক্রমেরও বিরাট ভূমিকা রয়েছে। বাংলাদেশ কিন্তু দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় মডেল। সারা বিশ্বের জন্যই মডেল। এখন মোবাইলে গুগল প্লে থেকে বিএমডি(বাংলাদেশ মেটেওরলজিক্যাল ডিপার্টমেন্ট) অ্যাপ নামালে যে কেউ আমাদের পূর্বাভাস তাৎক্ষণিকভাবেই জানতে পারে। স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীদের দেখানোর জন্য জাপানি সহায়তায় আবহাওয়াবিষয়ক একটি অ্যানিমেটেড ছবি তৈরি হয়েছে। কাজেই বলা দরকার, সব দিক থেকেই কাজ হচ্ছে।

আবহাওয়া অধ্যয়ন: ব্রিটিশ ভারত

কলকাতায় এশিয়াটিক সোসাইটি অভ বেঙ্গল প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১৭৮৪ সালে। পরের বছরই কলকাতায় আবহাওয়া পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র গড়ে ওঠে। তারপর মাদ্রাজে পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র গড়ে তোলা হয় ১৭৯৬ সালে।

মুম্বাইতে এশিয়াটিক সোসাইটি প্রতিষ্ঠা হয় ১৮০৪ সালে। সংস্থাটি মুম্বাইতে আবহাওয়াবিদ্যা অধ্যয়নও শুরু করে। ১৮৩৫ সালের দিকে কলকাতায় ক্যাপ্টেন হ্যারি পিডিংটন এশিয়াটিক সোসাইটি জর্নালে ৪০ পৃষ্ঠাব্যাপী ঝড় বিষয়ক এক নিবন্ধ প্রকাশ করেন আর তাতেই তিনি প্রথম সাইক্লোন শব্দটি ব্যবহার করেন। ১৮৪২ সালে তিনি প্রকাশ করেন তার বিখ্যাত গ্রন্থ ‘লজ অব দ্য স্টর্ম’।

এর মধ্যে ১৮৬৪ সালে কলকাতায় এক বিধ্বংসী ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানে। শেষে ১৮৭৫ সালে ব্রিটিশ সরকার প্রতিষ্ঠা করে ভারতীয় আবহাওয়া বিভাগ (আইএমডি)। উদ্দেশ্য ছিল বিচ্ছিন্নভাবে এদিক সেদিক আবহাওয়াবিষয়ক যেসব চর্চা হচ্ছে সেগুলোকে এক ছাতার নিচে নিয়ে আসা।

১৮৮৯ সালে ভারতীয় আবহাওয়া বিভাগের প্রথম মহাপরিচালক নিযুক্ত হন স্যার জন এলিয়ট। তখন সদর দপ্তর ছিল কলকাতায়। পরে তা শিমলায় এবং আরো পরে পুনায় সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়।

এদিকে বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় জেলা সাতক্ষীরায় প্রথম একটি আবহাওয়া পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করা হয় ১৮৬৭ সালে । ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পর সংস্থাটির নাম রাখা হয় পাকিস্তান আবহাওয়া সার্ভিস। শেষে ১৯৭১ সালে দেশের স্বাধীনতার পর এটি বাংলাদেশ আবহাওয়া বিভাগ হয়ে ওঠে।

সারা দেশে ছড়িয়ে

দিনাজপুরের রাজবাটি (প্রথম শ্রেণির আবহাওয়া পর্যবেক্ষণাগার), রংপুরের বাবু খাঁ (পাইলট বেলুন পর্যবেক্ষণাগার), পাবনার ঈশ্বরদী (পাইলট বেলুন পর্যবেক্ষণাগার), ময়মনসিংহের কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় (প্রথম শ্রেণির আবহাওয়া পর্যবেক্ষণাগার), হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর, চট্টগ্রামের আগ্রাবাদ (আবহাওয়া ও ভূপ্রাকৃতিক কেন্দ্র), মৌলভীবাজারের শাহ মোস্তফা রোডসহ ৪৩টি আবহাওয়া অফিস আছে সারা দেশে।

দপ্তরগুলো এমন—ফোরকাস্টিং, সিনপটিক আবহাওয়াবিদ্যা (ওয়েদার ম্যাপস, স্যাটেলাইট ইমেজ এবং স্টেশন রিপোর্ট সংরক্ষণ করা থাকে যেখানে), ইলেকট্রনিক অ্যান্ড ইনস্ট্রমেন্ট, ক্লাইমেট, আবহাওয়াবিদ্যা প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট, কৃষি আবহাওয়াবিদ্যা, ওয়ার্কশপ অ্যান্ড ল্যাবরেটরি, কমিউনিকেশন, স্টর্ম ওয়ার্নিং সেন্টার, সিসমিক অবজারভেশন অ্যান্ড রিসার্চ সেন্টার প্রভৃতি।

আবহাওয়া দপ্তর ডিউ ড্রপ নামে একটি জার্নাল প্রকাশ করে, নিউজলেটারও আছে।

আবহাওয়া দপ্তরের কিছু যন্ত্রপাতি

অবজারভেটরিতে গিয়ে প্রথম দেখলাম থিওডোলাইট (আলোর গতি পরিমাপক)। তারপর দেখলাম পাইলট সন্ডি (বাতাসের গতি পরিমাপক, বেলুনে গ্যাস ভরে উড়িয়ে দেওয়ার পর সেটি সিগনাল পাঠায় সন্ডিতে)। বেলুন ওড়ানোর চরকি আছে, আছে বেলুন নিয়ন্ত্রণের নাটাইও। ব্যারোমিটার (বাতাসের চাপ নির্ণায়ক যন্ত্র), ব্যারোগ্রাফও দেখলাম। আছে বৃষ্টি পরিমাপক (কাঠের তৈরি রুলার)।

এরপর ভবন থেকে বেড়িয়ে আবহাওয়া অফিসের উন্মুক্ত প্রান্তরে গেলাম। সেখানেই যন্ত্রপাতি বেশি রাখা। এখানে বৃষ্টির চার্ট দেখলাম, মাটির তাপমাত্রা পরিমাপক যন্ত্রও আছে, পেলাম ডিউ (শিশির) পয়েন্ট আর চার্ট। বাতাসের গতি ও দিক নির্ণায়ক যন্ত্র আছে। দিনের সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন তাপমাত্রা পরিমাপক যন্ত্রও আছে। শেষে সূর্যের আলোর প্রতিফলক উন্নতমানের আমেরিকায় প্রস্তুত পেপার দেখার মধ্য দিয়ে শেষ হলো যন্ত্রপাতি দেখার কাজ।

ঝড়, শিলাবৃষ্টি, ভূ-কম্পন, জলস্রোত, শিশির, পানির বাষ্পীভবন, দিন ও রাতের তাপমাত্রা,কুয়াশা, আর্দ্রতা—মোদ্দা কথা, আবহাওয়ার সবকিছুই পর্যবেক্ষণ ও অধ্যয়ন করে আবহাওয়া দপ্তর।

এখন আবহাওয়ার পূর্বাভাস আগের তুলনায় বেশি মিলে যাওয়ার পেছনের মূল কারণ প্রযুক্তির উন্নয়ন ও কর্মীদের অভিজ্ঞতা বৃদ্ধি।

আবহাওয়াবিদ কামরুল হাসান আশাবাদী, বাংলাদেশে আগামীতে আরো উন্নত হবে আবহাওয়া অধ্যয়ন কার্যক্রম।