ঢাকাবুধবার , ২৩ মার্চ ২০২২

টেক্সটাইল খাতকে চাঙা করার পরিকল্পনা

মার্চ ২৩, ২০২২ ১০:৫৮ পূর্বাহ্ণ । ১১৮ জন

গ্রীনসিটি ডেস্ক:

মিশ্র ইয়ার্ন ও ফেব্রিকের কাঁচামাল আমদানিতে ভ্যাট কমানোর দাবিও মেনে নেওয়ার কথা ভাবছে রাজস্ব বোর্ড টেক্সটাইল খাতের পাইপলাইনে আছে আড়াই বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ। এর পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় এ খাতকে বেশ কিছু করসুবিধা দেওয়ার সুপারিশ করেছে রাজস্ব কর্তৃপক্ষকে। এছাড়া রাজস্ব কর্তৃপক্ষও এই খাতের অর্থ ও সময় বাঁচাতে খাতটির জন্য কাস্টমস পদ্ধতিকে আরও সহজ করতে কাজ করছে। কাজেই টেক্সটাইল খাত সরকারের সুনজরেই রয়েছে বলা যায়। 

এসব সুযোগ-সুবিধা পেলে টেক্সটাইল শিল্প তার পরবর্তী উদ্যোগ আরও দ্রুত এগিয়ে নিতে পারবে। শিল্পটির পরবর্তী উদ্যোগ হচ্ছে ম্যানমেইড ফাইবার বা কৃত্রিম তন্তুর স্থানীয় উৎপাদন বাড়িয়ে পোশাক শিল্পের জন্য শক্তিশালী ব্যাকওয়ার্ড লিঙ্কেজ তৈরি করা এবং এর মাধ্যমে তুলার আমদানি খরচ কমানো।

টেক্সটাইল শিল্পের দীর্ঘদিনের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) টেক্সটাইল মিলের বিভিন্ন খুচরা যন্ত্রাংশ আমদানিতে হারমোনাইজড সিস্টেম (এইচএস) কোড-সংক্রান্ত জটিলতা নিরসনের পদক্ষেপ নিয়েছে।

মিশ্র ইয়ার্ন ও পলিয়েস্টার, সিনথেটিক, ভিসকস ও লাইক্রা-র (একত্রে কৃত্রিম ফাইবার হিসেবে পরিচিত) মতো কাপড়ের কাঁচামাল আমদানিতে ভ্যাট কমানোর দাবিও মেনে নেওয়ার কথা ভাবছে রাজস্ব বোর্ড।

আগামী অর্থবছরের বাজেট এখন তৈরির প্রক্রিয়ায় রয়েছে। এ সময় পাট ও বস্ত্র মন্ত্রণালয় ২০২৬ সাল পর্যন্ত টেক্সটাইল এবং স্পিনিং মিল মালিকদের জন্য আয়করের হার ১৫ শতাংশ রাখতে অনুরোধ করেছে এনবিআরকে। ২০২২ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত এই সুবিধা পাবে টেক্সটাইল ও স্পিনিং মিল মালিকরা।

আসন্ন জাতীয় শিল্পনীতির সঙ্গে সংগতি রেখে এই উদ্যোগগুলো নেওয়া হয়েছে। আমদানি বিকল্প শিল্পে মূলধন বিনিয়োগের ওপর কর প্রত্যাবর্তন ও ভর্তুকি দেয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে নতুন শিল্পনীতির খসড়ায়।

তুলা আমদানিতে বাংলাদেশ বছরে ৫৩ হাজার কোটি টাকা খরচ করে, যা দেশের মোট আমদানি ব্যয়ের ১৩ শতাংশ।

নতুন শিল্পনীতির খসড়ায় এ-জাতীয় আমদানিকে নিরুৎসাহিত এবং পোশাক, অটোমোবাইল ও ফার্মাসিউটিক্যালের মতো শিল্পের জন্য ক্যাপিটাল মেশিনারিজ এবং খুচরা যন্ত্রাংশের ব্যাকওয়ার্ড লিঙ্কেজ তৈরিতে ও স্থানীয় উৎপাদনে উৎসাহ দেয়া হয়েছে।

এছাড়া বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশন (বিটিএমএ) দীর্ঘদিন ধরে অভিযোগ করে আসছে যে এইচএস কোডের জটিলতার কারণে খুচরা যন্ত্রাংশের আমদানি ক্যাপিটাল মেশিনারি আমদানির চেয়ে ব্যয়বহুল হয়ে উঠছে।

এইচএস কোডের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করতে সোমবার (২১ মার্চ) ১২২টি ইলেকট্রিক্যাল, ইলেকট্রনিকস ও মেকানিক্যাল আইটেমের একটি তালিকা এনবিআরকে পাঠিয়েছে সংগঠনটি। এসব পণ্য আমদানিতে খরচ বেশি পড়ে।

এর আগে এ সমস্যার সমাধানে দুই পক্ষের মধ্যে বৈঠকের পর এনবিআর উদ্যোক্তাদের কাছে যন্ত্রপাতি ও যন্ত্রাংশের তালিকা চায়।

উদ্যোক্তারা জানান, তালিকাটি এনবিআর অনুমোদন দিলে এসব যন্ত্রপাতি ও যন্ত্রাংশ আমদানিতে সময়, অর্থ ও ঝামেলা কমবে।

এইচএস কোড হলো একটি সাধারণ আন্তর্জাতিক মানদণ্ড যা শুল্ক কর্মকর্তারা আমদানি-রপ্তানি পণ্য শনাক্ত করতে ব্যবহার করেন।

বর্তমানে শিল্প স্থাপনের জন্য যেকোনো ধরনের যন্ত্রপাতি আমদানিতে উদ্যোক্তাদের ১ শতাংশ শুল্ক দিতে হয়। এনবিআরের তথ্যমতে, সরঞ্জামের দামের ১০ শতাংশ পর্যন্ত দামের খুচরা যন্ত্রাংশ একই শুল্কে আমদানি করা যায়।

বিটিএমএ সূত্রে জানা গেছে, এনবিআরের কাছে ২০০টিরও বেশি আইটেমের জন্য এইচএস কোডের একটি তালিকা রয়েছে। এই ২০০ আইটেম হ্রাসকৃত শুল্ক হারের সুবিধা পায়। তালিকাটি দুই দশক আগে তৈরি করা। এখন কারখানাগুলোতে এমন অনেক নতুন সরঞ্জাম ও খুচরা যন্ত্রাংশ প্রয়োজন যা পুরোনো তালিকায় নেই।

বিটিএমএর সাবেক পরিচালক এবং লিটল স্টার স্পিনিং মিলস লিমিটেডের চেয়ারম্যান খোরশেদ আলম দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, ‘আমাদের এমন অনেক নতুন মেশিন ও খুচরা যন্ত্রাংশ প্রয়োজন যা এনবিআরের তালিকায় নেই। এসব খুচরা যন্ত্রাংশ আমদানি করা হলে শুল্ক কর্মকর্তারা এগুলো ছাড়তে চান না। সেক্ষেত্রে খুচরা যন্ত্রাংশের বাণিজ্যিক আমদানির জন্য আমাদের ২৬ শতাংশ বা তার বেশি শুল্ক-কর দিতে হয়।’

নাম প্রকাশ না করার শর্তে আরেক আমদানিকারক বলেন, ‘এসব যন্ত্রাংশ শিল্পে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতির। তালিকাভুক্ত না হওয়ায় এগুলো কম শুল্ক হারে ছাড়ার জন্য অতিরিক্ত অর্থ দাবি করেন শুল্ক কর্মকর্তারা। অতিরিক্ত অর্থ না দিলে তারা বিভিন্ন এইচএস কোডে পণ্যগুলোকে অন্তর্ভুক্ত করে বিপুল পরিমাণ শুল্ক আদায় করেন।’

এনবিআরকে দেওয়া এক চিঠিতে বিটিএমএর সভাপতি মোহাম্মদ আলী খোকন বলেছেন, ‘হ্রাসকৃত হারের তালিকায় সরঞ্জাম এবং খুচরা যন্ত্রাংশ অন্তর্ভুক্তির পর ২০ বছর পেরিয়ে গেছে। বাংলাদেশের টেক্সটাইল খাত এখন চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের যুগে প্রবেশ করেছে। তাই আমাদেরও তৃতীয় ও চতুর্থ প্রজন্মের যন্ত্রপাতি ব্যবহার করতে হবে।’

তিনি দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, ‘আমরা আশা করছি, উল্লিখিত খুচরা যন্ত্রাংশগুলো এনবিআরের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হলে এবং স্বল্প হারে আনতে দেওয়া হলে আমাদের জটিলতা ও হয়রানি কমবে।’

এদিকে কাস্টমসনীতি বিষয়ক এনবিআরের সাবেক সদস্য লুৎফর রহমান বলেন, ‘উদ্যোক্তাদের পাঠানো তালিকার যৌক্তিক অংশ অবশ্যই এনবিআর বিবেচনা করবে।’

এ বিষয়ে এনবিআরের শুল্ক বিভাগের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘উদ্যোক্তাদের দেওয়া তালিকায় আমাদের দেশীয় শিল্পে উৎপাদিত কোনো উচ্চ-শুল্ক যন্ত্রাংশ আছে কি না তা বিবেচনা করতে হবে।’

টেক্সটাইল শিল্পের করহার কম রাখুন: এনবিআরকে মন্ত্রণালয়

বস্ত্র মন্ত্রণালয় সাম্প্রতিক এক চিঠিতে বলে, টেক্সটাইল খাতের উন্নয়ন এবং রপ্তানি আয় বাড়ানোর জন্য শিল্পের সংগঠন বিটিএমএর অনুরোধ টেক্সটাইলের ওপর বিদ্যমান নিম্ন করের পরিমাণ বাড়ানো উচিত এনবিআর-এর।

সুতা উৎপাদন, ডাইং, ফিনিশিং, কোনিং, ফেব্রিক উৎপাদন, ফেব্রিক ডাইং, ফিনিশিং, প্রিন্টিং এবং অন্যান্য অনুরূপ কাজের সঙ্গে জড়িত উদ্যোক্তারা এতে সুবিধা পাবেন। আগামী বাজেটে কর বাড়ানো হলে ব্যবসার ব্যয় বেড়ে যাবে। এতে টেক্সটাইল শিল্প বিশ্ববাজারে প্রতিযোগিতা সক্ষমতা হারাবে বলে জানিয়েছেন এই খাতের উদ্যোক্তারা।

চিঠিতে টেক্সটাইল শিল্পকে একটি ভারী শিল্প হিসাবে আখ্যায়িত করে মন্ত্রণালয় বলে, ২০১৫ সালে কমানো করের হার অব্যাহত রাখা উচিত। বিশ্ববাজারের চাহিদা মেটাতে ২০২৩ সালের মধ্যে দেশের টেক্সটাইল খাত ২.৫ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করে ২.৫ মিলিয়ন স্পিন্ডেল যুক্ত করতে প্রস্তুত রয়েছে বলে উল্লেখ করা হয় ওই চিঠিতে।

এছাড়া, ভবিষ্যতের চাহিদা মেটাতে বৈচিত্র্যময় এবং আধুনিক সুতা ও কাপড় উৎপাদনের জন্য বেশ কিছু উদ্যোক্তা ইতোমধ্যেই কৃত্রিম তন্তু উৎপাদনে বিনিয়োগ করেছে।

বিটিএমএর তথ্যমতে, গত বছর পোশাক উদ্যোক্তারা ৫.৫২ লাখ টন ওভেন কাপড় আমদানি করেছে; যা ২০২০ সালে ছিল প্রায় ৪.২১ লাখ টন। সংগঠনটি আরও জানায়, রপ্তানিমুখী নিট পোশাকের চাহিদার ৮০ শতাংশ পূরণ করে স্থানীয় স্পিনিং মিলাররা, অথচ তারা ওভেন কাপড়ের মাত্র ৪০ শতাংশ সরবরাহ করে।

বাংলাদেশ এখনও সুতি কাপড়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়ায় নন-কটন কাপড়ের প্রায় ৬০ শতাংশ চাহিদা মেটাতে আমদানির উপর নির্ভর করতে হয় ওভেন পোশাক প্রস্তুতকারকদের। মোহাম্মদ আলী খোকন বলেন, টেক্সটাইল একটি পুঁজিনির্ভর শিল্প হওয়ায় বিশাল টার্নওভার ট্যাক্স এক্ষেত্রে অতিরিক্ত বোঝা হয়ে দাঁড়াবে। এতে ব্যবসার খরচ বাড়বে এবং তা পোশাক রপ্তানিকারকদের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলবে।

বর্তমানে তৈরি পোশাকে করের হার ১২ শতাংশ। এছাড়া টেক্সটাইল খাতে করের হার ১৫ শতাংশ। তবে কোনো পোশাক নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের সবুজ কারখানা সনদ থাকলে এই হার ২০০ বেসিস পয়েন্ট কমিয়ে হিসাব করা হবে। সাধারণত, দেশে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে কর্পোরেট করের হার ২২ দশমিক ৫ শতাংশ এবং তালিকাভুক্ত নয়, এমন প্রতিষ্ঠানের এই করের হার ৩০ শতাংশ।- দি বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড