গ্রীনসিটি ডেস্ক:
বাংলা সন বা বঙ্গাব্দ কে প্রতর্বন করছিলেন তা নিয়ে ভারতীয় কয়েকটি হিন্দুত্ববাদী সংগঠন বিতর্ক তুললেও বাংলাদেশে গবেষক ও ইতিহাসবিদরা একমত যে এর সূচনা হয়েছিল সম্রাট আকবরের হাতে।
তারা বলছেন যে গৌড়ের প্রাচীন হিন্দু রাজা শশাঙ্ক নন, বরং মুঘল সম্রাট আকবরই বাংলা সন বা বঙ্গাব্দ প্রবর্তন করেছিলেন।
অনেক ইতিহাসবিদ ও নৃতাত্ত্বিক অবশ্য এও মনে করেন যে বাঙ্গালিদের মধ্যে কৃষির সূচনা থেকেই বাংলা সনের উদ্ভব। কিন্তু ঠিক কবে বা কখন তা শুরু হয়েছে, তা নিয়ে সুনির্দিষ্ট কোন সিদ্ধান্তে আসা যায়নি।
তবে সাম্প্রতিক সময়ে বঙ্গাব্দ’র প্রবর্তক হিসেবে ভারতের হিন্দুত্ববাদীরা গৌড়ের প্রাচীন রাজা শশাঙ্ককে তুলে ধরতে চেষ্টা করছেন, যা নিয়ে ওই দেশেই ভিন্ন মত রয়েছে।
ইতিহাসবিদ সৈয়দ আনোয়ার হোসেন জানাচ্ছেন যে সুপরিচিত ভারতীয় বিজ্ঞানী ডঃ মেঘনাদ সাহা থেকে শুরু করে সাম্প্রতিক কালের ডঃ অমর্ত্য সেন পর্যন্ত অনেক বিজ্ঞানী, ইতিহাসবিদ ও নৃতত্ত্ববিদ সম্রাট আকবরকেই বাংলা সনের প্রবর্তক হিসেবে মেনে নিয়েছেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক এই শিক্ষক বলেন, ইতিহাস বিবেচনায় মুঘল সম্রাট আকবরই বাংলা সন বা বঙ্গাব্দের উদ্ভাবক।
“১৯৫৪ সালে ভারতীয় পঞ্জিকা সংস্কার কমিটির প্রধান ডঃ মেঘনাদ সাহা অঙ্ক কষে নিশ্চিত ঘোষণা করেছিলেন যে সম্রাট আকবরই বাংলা সনের প্রবর্তক। পরে উড়িষ্যার ইতিহাসবিদ কাশীপ্রসাদ জয়সোবাল এ মতকে সমর্থন করেছিলেন।
“আমিও মনে করি, ইতিহাসের অভিমত হলো সম্রাট আকবরই ফসলী সন হিসেবে বাংলা সন চালু করেছিলেন”।
অধ্যাপক সৈয়দ আনোয়ার হোসেন বলেন, হিজরী সনকে সৌর বছরে পরিণত করে বাংলা সন চালু করা হয়েছিলো, এবং সম্রাট আকবর যা চেয়েছিলেন তা হলো রাজস্ব প্রশাসনের সংকট দূর করা।
আর তার এই প্রয়াসের মধ্য দিয়েই বাংলা সনের উদ্ভব হলো।
বাংলা সন নিয়ে চার অভিমত
এই বাংলা সনই বাংলাদেশের গ্রামীণ সমাজ ও কৃষিখাতে সবসময় নানা উপলক্ষে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। অর্থাৎ ফসল থেকে আরম্ভ করে ব্যবসা – সব কাজেই এর গুরুত্ব অপরিসীম।
এখনও অধিকাংশ জায়গায় দোকান ভাড়া কিংবা ব্যবসার হিসেব-নিকেশ করার ভিত্তি হলো ৩০শে চৈত্র কিংবা পহেলা বৈশাখ।
বাংলাদেশে বাংলা সনের শেষ দিন ৩০শে চৈত্র তারিখে চৈত্র সংক্রান্তি আর বছরের প্রথম দিন পহেলা বৈশাখে নববর্ষ এই কারণেই ঘটা করে পালিত হয়ে আসছে দীর্ঘকাল ধরে।
অধ্যাপক সৈয়দ আনোয়ার হোসেন জানান, বাংলা সন কে চালু করেছিলেন তা নিয়ে ইতিহাসে চারটি অভিমত আছে।
একটি হচ্ছে তিব্বতের রাজা স্রং সন (ইনি ৬০০ খ্রিস্টাব্দের কিছু আগে রাজা হন এবং মধ্যভারত ও পূর্ব ভারত জয় করেন) বঙ্গাব্দ চালু করেছিলেন, কারণ ওই সময় বাংলার উত্তরাঞ্চলের অনেকটাই তিব্বতি সাম্রাজ্যের অঙ্গীভূত ছিলো।
আর বাঙ্গালা শব্দটি তিব্বতি শব্দ বন্ স থেকে এসেছে, যার অর্থ ভেজা মাটি, যা আসলেই বাংলাদেশ।
দ্বিতীয় অভিমত হলো, শশাঙ্ক – যিনি বাংলা অঞ্চলে একজন স্বাধীন রাজা ছিলেন – বঙ্গাব্দ চালু করেন। তৃতীয় অভিমতে বলা হয় যে সুলতান আলাউদ্দিন হোসেন শাহ বাংলা সনের প্রবর্তক, আর সর্বশেষ অভিমত হলো সম্রাট আকবর ছিলেন বঙ্গাব্দের প্রবর্তক।
পরে ইতিহাস ও গণিতবিদদের বেশিরভাগই তাদের পর্যালোচনা থেকে বলেছেন যে সম্রাট আকবরই বাংলা সনের প্রবর্তক, বলেন অধ্যাপক হোসেন।
প্রায় একই অভিমত দিয়েছেন প্রয়াত গবেষক শামসুজ্জামান খান। বাংলা একাডেমির এই সাবেক মহাপরিচালক তার বইয়েও বাংলা সনের প্রবর্তন নিয়ে বিস্তারিত তথ্য দেয়ার চেষ্টা করেছেন।
তিনি লিখেছেন, পণ্ডিত ও ঐতিহাসিকরা যার যার দৃষ্টিকোণ থেকে পরোক্ষ প্রমাণ ও অনুমানের মাধ্যমে বাংলা সনের প্রবর্তক হিসেবে চারজন সম্রাট, রাজা বা সুলতানের নাম সামনে নিয়ে এসেছেন।
এঁরা হলেন মোগল সম্রাট আকবর, সুলতান হোসেন শাহ, রাজা শশাঙ্ক এবং তিব্বতি রাজা স্রং সন ।
এঁদের মধ্যে অমর্ত্য সেনসহ অধিকাংশ পণ্ডিত সম্রাট আকবরকেই বাংলা সনের প্রবর্তক মনে করেন বলে লিখেছেন মিস্টার খান।
সম্রাট আকবর ১৫৫৬ খ্রিষ্টাব্দে সিংহাসনে আরোহণ করেন। তখন হিজরী সন ছিল ৯৬৩ এবং বাংলা সনও ছিল ৯৬৩ বঙ্গাব্দ।
দেশ শাসনের ২৯তম বছরে হিজরী ৯৯২ সালে তিনি পঞ্জিকা সংস্কারে হাত দিয়েছিলেন বলে জানা যায়।
মিস্টার খান লিখেছেন, “আইন-ই-আকবরী থেকে জানা যায়, সম্রাট এমন একটি ত্রুটিমুক্ত এবং বিজ্ঞানসম্মত সৌর সনের প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন, যা জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সবার জন্যই আদর্শ হবে। বাংলা সনের মধ্যে তার সে আকাঙ্ক্ষা পূর্ণ হয়েছিল”।
ওই লেখায় তিনি আবুল ফজলের আইন-ই-আকবরী গ্রন্থের উদ্ধৃতি দিয়েছেন।
“আকবর বহুদিন ধরে হিন্দুস্থানের বিভিন্ন অঞ্চলে (দিন গণনার) সমস্যা সহজ করে দেওয়ার জন্য এক নতুন বছর ও মাস গণনাক্রম প্রবর্তন করতে ইচ্ছুক ছিলেন। তিনি হিজরী অব্দ ব্যবহারের বিরোধী ছিলেন। আমীর ফয়জুল্লাহ শিরাজীর প্রচেষ্টায় এ অব্দের প্রবর্তন হল।”
ঢাকায় বাংলা একাডেমির ফোকলোর বিভাগের উপপরিচালক ডঃ আমিনুর রহমান সুলতান বলছেন যে বাঙ্গালী বরাবরই পার্বণ প্রিয় জাতি। কিন্তু সম্রাট আকবরের আগে অর্থাৎ শশাঙ্ক থেকে আকবর পর্যন্ত সময়ে পার্বণের তেমন উল্লেখ কোথাও পাওয়া যায় না।
তবে সম্রাট আকবরের পরে ময়মনসিংহ গীতিকায় কিন্তু পহেলা বৈশাখ বা নতুন বছরের প্রভাব দেখা যায় বলে জানান তিনি।
বাংলা সন নিয়ে হিন্দুত্ববাদীদের দাবি
ভারতের হিন্দুত্ববাদী গোষ্ঠী আরএসএস ও তাদের অনুসারী সংগঠনগুলো পশ্চিমবঙ্গে জোরালো প্রচার ও ‘সচেতনতা অভিযান’ শুরু করেছে এই বলে যে মুঘল সম্রাট আকবর নন, বরং গৌড়ের প্রাচীন হিন্দু রাজা শশাঙ্কই যে বাংলা সন বা ‘বঙ্গাব্দ’ প্রবর্তন করেছিলেন।
পশ্চিমবঙ্গে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ বা আরএসএসের তাত্ত্বিক নেতা ও পরিচিত মুখ জিষ্ণু বসু এমন যুক্তি দেন যে আকবরের জীবদ্দশায় তিনি বাংলার ওপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ কখনোই পাননি, ১৫৭৬-য়ে রাজমহলের যুদ্ধ জিতে মুঘলরা প্রথম বাংলা দখল করলেও তারপরও বহু বছর ধরে যুদ্ধ চলেছিল।
“আর বেছে বেছে সেই অস্থির বাংলাতেই আকবর একটা নতুন সাল চালু করবেন, সেটা খুব অস্বাভাবিক”, বলেছিলেন ড. বসু।
ঢাকায় বাংলা একাডেমির ডঃ আমিনুর রহমান সুলতান মনে করেন যে বাংলা সনের সূচনা নিয়ে বিতর্কটি তোলা হয়েছে কারণ পশ্চিমবঙ্গের হিন্দুত্ববাদীরা রাজা শশাঙ্ককেই এর প্রবর্তক হিসেবে দেখাতে চান।
“এটা আসলে আকবরই শুরু করেছিলেন। অমর্ত্য সেন ও অধ্যাপক পবিত্র সরকারের মতো লেখক ও গবেষকরা দেখিয়েছেন যে সম্রাট আকবরের সময় থেকেই বাংলা সনের প্রবর্তন হয়েছে,” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তিনি।
বাংলা সন ও কৃষির হিসেব-নিকেশ
গবেষক ও বিশ্লেষকরা বলছেন যে বাংলা অঞ্চল তখন হিজরী সনে পরিচালিত হতো। কিন্তু বাংলা ছিলো কৃষি প্রধান, ফলে খাজনা দেয়াসহ নানা কাজে বছরের শুরুটা হিসেব করতে সমস্যা হতো।
এ কারণেই সম্রাট আকবর তখন বাংলা সন প্রবর্তন করেছেন, পহেলা বৈশাখ দিয়ে যার শুরু।
বাংলা সন নিয়ে গবেষণা করা কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্বের শিক্ষক শারমিন রেজওয়ানা জানান, রাজা শশাঙ্ক যেটা করেছিলেন সেটা শতাব্দ। আর সম্রাট আকবর যে সন চালু করেছিলেন সেটি বঙ্গাব্দ এবং এটি ছিলো কৃষকদের কর দেয়ার সাথে সম্পর্কিত।
“তখন কর দেয়ার সময়ে ফসল উঠতো না। ফলে কৃষকদের কর দিতে সমস্যা হতো। সে কারণেই সম্রাট আকবর পহেলা বৈশাখের প্রথা প্রচলন করেন। আর শশাঙ্কের শতাব্দের সাথে বাংলা সনের সাথে মিলও খুব কম,” বলছিলেন তিনি।
তবে বাংলা সন নিয়ে যত বিতর্কই হোক না কেন বাংলা পঞ্জিকা সংস্কারের প্রয়াস ছিলো দীর্ঘদিন ধরে।
ডঃ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ এর সূচনা করেছিলেন। পরে সরকার বাংলা একাডেমির মাধ্যমে সেটি বাস্তবায়ন করে।
বাংলা বর্ষপঞ্জি সংস্কারে বাংলা একাডেমি সাম্প্রতিক সময়ে যে কমিটি করেছিলো তার একজন সদস্য ছিলেন অপরেশ কুমার ব্যানার্জি। তিনি জানান, আগে বাংলায় বছরের শুরু হতো অগ্রহায়ণ দিয়ে, কারণ তখন কৃষকের ঘরে ফসল আসতো।
কিন্তু খাজনা আদায়সহ নানা কিছু চিন্তা করেই বাংলা সন পহেলা বৈশাখ থেকে নির্ধারণ করা হয়, তিনি বলেন।
বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সঙ্গে জড়িত ঐতিহাসিক দিবসগুলোকে গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারের সাথে সমন্বয় করতে বাংলাদেশে ২০১৯ সালে বাংলা ক্যালেন্ডার পরিবর্তন করা হয়েছে।
মিস্টার ব্যানার্জি বলেন, “বাংলা পঞ্জিকা সমন্বয় করার ফলে গুরুত্বপূর্ণ দিনগুলোতে (গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারের বিপরীতে) বাংলা তারিখ আর পরিবর্তিত হবে না”।
তবে এই পরিবর্তন কেবল বাংলাদেশের জন্যই করা হয়েছে। ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, যেখানে বাংলা একটি অন্যতম সরকারি ভাষা, সেখানে এই পরিবর্তন গ্রহণ করা হয়নি।
বিবিসি বাংলা
