ঢাকাবৃহস্পতিবার , ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২২
  • অন্যান্য

আগে থেকে প্রশ্নফাঁসে জড়িত ছিল চক্রটি

সেপ্টেম্বর ২৯, ২০২২ ১২:২৬ অপরাহ্ণ । ১২২ জন

 এসএসসি পরীক্ষার প্রশ্নফাঁস তদন্তে বুধবার কুড়িগ্রামের ভুরুঙ্গামারী ঘুরে গেছে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা অধিপ্তরের রংপুর অঞ্চলের পরিচালকের নেতৃত্বে দুই সদস্যের একটি দল। টিমের সদস্যরা নেহাল উদ্দিন পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্র ও পাশের কেন্দ্রের সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলেন। তবে তদন্তে কী পেয়েছেন তা তারা সংবাদ মাধ্যমকে বলতে রাজি হননি।

অনুসন্ধানে উঠে এসেছে, কয়েক বছর ধরেই প্রশ্নফাঁসে জড়িত চক্রটি। মূলত বিদ্যালয়ের ফল ভালো দেখাতে এ কাজে জড়ায় তারা। তবে একপর্যায়ে অন্য স্থানেও প্রশ্ন বিক্রি করা শুরু করে। এর মাধ্যমে চক্রের একাধিক সদস্য মোটা অংকের টাকা কামিয়েছেন।

প্রশ্নফাঁসে বাতিল হওয়া ২ বিষয়ের মধ্যে ১ম পরীক্ষা (জীববিজ্ঞান) বুধবার অনুষ্ঠিত হয়েছে। উপজেলার ৪ পরীক্ষা কেন্দ্রে ৬৪৯ পরীক্ষার্থী এতে অংশ নেয়। পরীক্ষার্থী ফুয়াদ হাসান, মারুফ হোসেন মোজাম্মেল হক জানান, প্রশ্নফাঁস নিয়ে ভয় ছিল, তবে শেষপর্যন্ত পরীক্ষা ভালো হয়েছে। অভিভাবকরা জানিয়েছেন, পরীক্ষা কেন্দ্রের পরিবেশ এদিন ভালো ছিল। বাতিল হওয়া উচ্চতর গণিতের পরীক্ষা শনিবার অনুষ্ঠিত হবে। আর স্থগিত হওয়া চার বিষয়ের পরীক্ষা হবে নতুন রুটিন অনুযায়ী ১০-১৫ অক্টোবর।

প্রশ্নফাঁসের ঘটনায় করা মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ওসি (তদন্ত) আজাহার আলী বুধবার বলেন, পলাতক আসামিদের গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে। যারা গ্রেফতার হয়েছে তাদের জিজ্ঞাসাবাদে জড়িত অন্যদের নাম আসতে পারে। এজন্য রিমান্ডের আবেদন জানানো হয়েছে। কুড়িগ্রাম চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত এ কাল (আজ) শুনানি হবে।

এসএসসি পরীক্ষার প্রশ্নফাঁসের অভিযোগে ২০ সেপ্টেম্বর রাতে তিন শিক্ষককে গ্রেফতার করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এরপরই বেরিয়ে আসে সাত বিষয়ে প্রশ্নফাঁসের তথ্য। দুটি পরীক্ষা বাতিল করা হয়, চারটি করা হয় স্থগিত।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, ২০১৬ থেকে একই পদ্ধতিতে অষ্টম শ্রেণির প্রশ্নফাঁস শুরু করে চক্রটি। তখন উদ্দেশ্য ছিল, নিজেদের বিদ্যালয়ের ফলাফল ভালো করা। আর ফাঁসে জড়িত ছিল ২-৩ জন শিক্ষক। পরে চক্রের সদস্য বাড়ানো হয় এবং বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ছাড়াও প্রশ্নপত্র বিক্রি করা হয়।

তদন্তসংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানায়, ১০ সেপ্টেম্বর দিনাজপুর শিক্ষা বোর্ড’র কেন্দ্র সচিবদের সভা ছিল। সেখানে নেহাল উদ্দিন পাইলট বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ও কেন্দ্র সচিব লুৎফর রহমান উপস্থিত ছিলেন। পরের দিন বোর্ড মিটিংয়ের কথা বলে তিনি এলাকায় ছিলেন না। প্রশ্নফাঁসের বায়নার (অগ্রিম) টাকা নিতেই তিনি সেদিন রংপুর গিয়েছিলেন। বরখাস্ত মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা আব্দুর রহমানও সেখানে ছিলেন। তিনি ভুরুঙ্গামারীতে যোগ দেওয়ার পর থেকে জড়িয়ে পড়েন নানা অনিয়ম ও দুর্নীতিতে।

তদন্ত কমিটির সদস্যরা জানতে পারেন, শুধু তত্ত্বীয় প্রশ্ন ফাঁস করা হয়নি। এর সঙ্গে নৈর্ব্যক্তিক বিষয়ের প্রশ্নপত্রও ফাঁস করা হয়েছে। নৈর্ব্যক্তিক বিষয়ের গণিত (বি-সেট) ৪টি খামের মধ্যে ২০ প্রশ্নের ১টি খাম, উচ্চতর গণিতের (বি) ২ খামের মধ্যে ২০ প্রশ্নের ১টি খাম, পদার্থ বিজ্ঞান (সি) ৩ খামের মধ্যে ২০টির ১টি খাম, রসায়ন (এ)৩টি মধ্যে ২০টি প্রশ্নের ১টি খাম, জীব বিজ্ঞান (এ) ৩টি খামের মধ্যে ২০ প্রশ্নের ১টি খাম, কৃষি বিজ্ঞানের (বি) ৪টি খামের মধ্যে ২০টি প্রশ্নের ১টি খাম পাওয়া যায়নি। তত্ত্বীয় বি সেটের গণিতের ১১ খামের মধ্যে ৫০টির ১টি খাম, কৃষি (তত্ত্বীয়) ১০টি খামের মধ্যে ৫০টি প্রশ্নের ১টি, পদার্থ (তত্ত্বীয়) ৪টির মধ্যে ৫০টির ১টি, উচ্চতর গণিত (তত্ত্বীয়) ২টি খামের মধ্যে ৫০টির ১টি খাম, রসায়ন ৪টি খামের মধ্যে মধ্যে ৫০টি একটি, জীববিজ্ঞান (তত্ত্বীয়) ৪টি খামের মধ্যে ১টি খাম পাওয়া যায়নি। একইভাবে এ-সেটের প্রশ্নপত্রও ফাঁস করা হয়েছে।

অনুসন্ধানে জানা যায়, প্রধান শিক্ষক লুৎফর রহমান এসএসসি ২য় বিভাগ, এইচএসসি বিশেষ বিবেচনায় (কম্পার্মেন্টাল) এবং স্নাতক ৩য় বিভাগে পাস করেন। তিনি শ্বশুরের (তিলাই ইউনিয়নের নাসির উদ্দিন) প্রভাব খাটিয়ে সহকারী শিক্ষক হিসাবে প্রথমে হামিদা খানম উচ্চ বিদ্যালয়ে যোগ দেন। পরে একই কায়দায় ভুরুঙ্গামারী সদরে নেহাল উদ্দিন পাইলট উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক নিয়োগ পান। এরপর থেকেই তাকে পিছু তাকাতে হয়নি। তিনি নিজবাড়ী রামখানার নাহারগঞ্জে কয়েক বিঘা জমি কিনেছেন। ভুরুঙ্গামারী শহরের মাস্টার পাড়া ও বাসস্ট্যান্ড পাড়ায় কিনেছেন ১৬ শতক জমি। যার মূল্য প্রায় কোটি টাকা।

তদন্ত সূত্র আরও জানায়, লুৎফর রহমানের অন্যতম সহযোগী মাওলানা যুবায়ের হোসেন ভোটহাট দাখিল মাদ্রাসার সুপার ছিলেন। সেখান থেকে ইসলাম ধর্ম বিষয়ে নেহাল উদ্দিন পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ে নিয়োগ পান। কিন্তু এনটিআরসিএ সার্টিফিকেট ভুয়া থাকায় তার এমপিওভুক্তি হয়নি। এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দিলেও প্রধান শিক্ষক কোনো ব্যবস্থা নেননি। বরং খণ্ডকালীন শিক্ষক হিসাবে তাকে নিয়োগ দেন। পাশাপাশি প্রশ্নের গ্রাহক সংগ্রহের দায়িত্বও দেন। এক কথায় ক্যাশিয়ারের দায়িত্ব পালন করতেন যুবায়ের।

তদন্ত কার্যক্রম : বুধবার সরেজমিন তদন্ত করতে আসা কর্মকর্তারা হলেন পরিচালক আব্দুল মতিন ও উপ-পরিচালক মো. আখতারুজ্জামান। তারা দুপুরে নেহাল উদ্দিন পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় পরীক্ষাকেন্দ্রে বরখাস্ত মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা আব্দুর রহমান, সহকারী মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা সাজ্জাদ হোসেন, বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সভাপতি একেএম মাহমুদুর রহমান রোজেন, ওই কেন্দ্রের সচিব ও ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক খলিলুর রহমান পলাশ ও নেহাল উদ্দিন পাইলট বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকদেরও জিজ্ঞাসাবাদ করেন। পরে তারা পার্শ্ববর্তী পরীক্ষা কেন্দ্র ভুরুঙ্গামারী পাইলট সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে যান। সেখানে প্রধান শিক্ষক ও কেন্দ্র সচিব মো. শাহজাহান আলীর সঙ্গেও কথা বলেন। সূত্রমতে, মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের পক্ষে তারা এ তদন্ত কার্যক্রম পরিচালনা করছেন।

প্রশ্নফাঁসের ঘটনায় ২০ সেপ্টেম্বর নেহালউদ্দিন পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক লুৎফর রহমান, সহকারী শিক্ষক যুবায়ের হুসাইন, আমিনুর রহমানকে এবং ২২ সেপ্টম্বর হামিদুল ইসলাম, সোহেল আল মামুন ও অফিস পিয়ন সুজন মিয়াকে পুলিশ গ্রেফতার করে পুলিশ। দায়িত্ব অবহেলার কারণে মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা আব্দুর রহমানকে সাময়িক বরখাস্ত এবং উপজেলা নির্বাহী অফিসার দীপক কুমার দেব শর্মাকে কারণ দর্শাও নোটিশ দেওয়া হয়।- দৈনিক শিক্ষা

Paris