ঢাকাসোমবার , ৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৩

ঋত্বিক ঘটকের সীমান্তহীন বাঙালিত্বের অভিলাষ

ফেব্রুয়ারি ৬, ২০২৩ ২:০৪ অপরাহ্ণ । ২০৯ জন

মানুষ মাত্রই স্বপ্নচারী। কোনো না কোনো স্বপ্নের জাল বুনে মানুষ প্রবহমান রাখে জীবনের গতি। কিন্তু সব মানুষের পক্ষে সর্বজনীন স্বপ্ন দেখা কি সম্ভব? নিশ্চয়ই নয়! যারা সেই স্বপ্ন দেখেন তাদের সংখ্যা একেবারেই হাতেগোনা। সেইসব স্বপ্নবিলাসী মানুষেরই একজন ঋত্বিক ঘটক।

তার নাম উচ্চারিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই একজন চলচ্চিত্র নির্মাতার মুখ আমাদের সামনে ভেসে ওঠে। যিনি আজীবন একটি স্বপ্ন লালন করে, সেই স্বপ্নকে পূর্ণতা দানের চেষ্টা করেছেন। আমার এমন অভিব্যক্তির পর খটকা লাগতে পারে মনে, বলতে পারেন—তিনি তো স্বপ্ন ফেরি করেননি, করেছেন বেদনার বিলাপ।

দেশভাগের যাতনাকে চেষ্টা করেছেন ভাষা দিতে? এখানে স্বপ্ন এলো কী করে? আমি আপনার যুক্তিকে অগ্রাহ্য না করে, সবিনয় অনুরোধ করবো দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের। তাহলে বিশাল এক স্বপ্নচারী মানুষ দেখতে পাবেন আপনি। যার মাঝে খুঁজে পাবেন অনন্য এক সীমান্তহীন বাঙালিকে।

আমাদের সৃজনবিশ্বে এমন কিছু মানুষ আছেন যাদের নাম উচ্চারিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তাদের কর্ম প্রতিভাত হয়। ব্যক্তি ছাপিয়ে সামনে চলে আসে তাদের সৃষ্টিশীলতা। একথা দ্বিধাহীনভাবেই বলতে পারি, ঋত্বিক ঘটক তেমনই একজন মানুষ। তার নামটি উচ্চারিত হওয়ার পরপরই তার অমরত্বের তিলকপরা মুখটি আমাদের মানসপটে ভেসে ওঠে।

দেশভাগের যে ক্ষত তাতে বিক্ষত হয় মন। স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে, এত এত বিষয় থাকতে দেশভাগের আখ্যান নিয়েই কেন চলচ্চিত্র নির্মাণে উদ্যোগী হয়েছিলেন ঋত্বিক? সরলরেখায় বলে দেওয়া যায় এর উত্তর। আসলে ভাগাভাগিই মেনে নিতে পারেননি তিনি। অবিভক্ত যে ভূমিতে তার জন্ম, সেই ভূমি তো বিভাজিত হলোই, সেই সঙ্গে দেশভাগের কারণে তাকে বিতাড়িত হতে হলো জন্মভূমি থেকে।

দেশভাগের যে ক্ষত তাতে বিক্ষত হয় মন। স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে, এত এত বিষয় থাকতে দেশভাগের আখ্যান নিয়েই কেন চলচ্চিত্র নির্মাণে উদ্যোগী হয়েছিলেন ঋত্বিক?

যে পরিবেশ, প্রতিবেশ, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক আবহে ঋত্বিকের বেড়ে ওঠা, তা অতীত হয়ে যাওয়া, স্মৃতির ক্যানভাসে আবদ্ধ হয়ে যাওয়াকে একজন সুস্থ মানুষ হিসেবে মেনে নেওয়া সম্ভব হয়নি। কিন্তু মেনে না নিলে কী হবে, সেই দেশভাগের ক্ষত হৃদয়ে ধারণ করেই তাকে অগ্রগামী হতে হলো, অভিযাত্রী হতে হলো জীবনের।

যখন তিনি চলচ্চিত্রে নিমগ্ন হলেন, তখন তার মনের মধ্যে জাগরূক থাকা রক্তাক্ত বিরহ কাতরতা ভাষা দেওয়ার চেষ্টা করলেন। চরিত্রগুলো এতটাই জীবন্ত করে উপস্থাপন করলেন যে তারা পেল অমরতা। সেই অমরতাই ব্যক্তিকতা ছাপিয়ে ঋত্বিক ঘটক নামকে পরিণত করল প্রতিষ্ঠানে।

দেশভাগ ঋত্বিক ঘটককে শুধু এপার থেকে ওপারে নিয়ে যায়নি, তার ভালোবাসা আর বিশ্বাসের ভিতকে আহত করেনি, করেছে বোনহারা! কৈশোরে যমজ বোন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া ঋত্বিকের কাছে ছিল এক অবর্ণনীয় দুঃখের।

দেশভাগ না হলে প্রিয় বোনকে রেখে ওপারে যেতে হতো না তাকে। যমজ বলে, একের দুঃখগাঁথা অন্যকে ছুঁয়েছে অহর্নিশ। দেশভাগ না হলে কিন্তু এমনটি হতো না। এমন বেদনা শুধু তার একার ছিল না। যারা তাদের স্বজন হারিয়েছেন, তাদের প্রত্যেকেরই, যারা নির্যাতিত হয়েছিলেন তাদের সকলের।

সেই দুর্বিষহ সময় তার বিবেককে করেছে রক্তাক্ত। ভবিষ্যতে যেনও এমন পরিস্থিতি আর না আসে সেই জন্যই মানুষের বিবেককে জাগ্রত করায় অভিনিবেশ করেছিলেন তিনি এবং মানুষের কাছে পৌঁছানোর জন্য বেছে নিয়েছিলেন এই পথকে।

কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাঙালিদের উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন, ‘সাত কোটি সন্তানেরে, হে মুগ্ধ জননী, রেখেছ বাঙালী করে, মানুষ কর নি।’ রবীন্দ্রনাথের স্পর্শধন্য ঋত্বিক ঘটক, মানুষ না হওয়া মানুষের অমানবিকতা তুলে ধরে মানুষ হওয়ার শিক্ষা দিতেই বাস্তবতা দিয়ে সাজিয়েছেন সেলুলয়েডের ফিতায়।

আমরা দেশভাগ নিয়ে তার অমর সৃষ্টি ‘মেঘে ঢাকা তারা’ (১৯৬০), ‘কোমল গান্ধার’ (১৯৬১) ও ‘সুবর্ণরেখা’ (১৯৬৫), গভীরভাবে পর্যালোচনা করলে দেখতে পাই, দেশভাগের যে ক্ষত তার মনের মধ্যে ছিল তার প্রকাশ তিনি এতটাই সুনিপুণভাবে করেছেন চলচ্চিত্রে যা আর কারো পক্ষে এর আগে সম্ভব হয়নি।

দেশভাগের ফলে বাংলার ভাগ হয়ে যাওয়া তিনি কোনোভাবেই মেনে নিতে পারেননি। ভাগাভাগির সেই সময় ঋত্বিকের বয়স ছিল ২২ বছর। স্বপ্নরঙিন মন ও মননে ছিল ঐক্য ও অসাম্প্রদায়িকতার বাতাবরণ।

এই কারণে বাঙালিরা যে ক’জন চলচ্চিত্রকার নিয়ে গর্ব করেন তার মধ্যে তিনি শীর্ষস্থানীয়। দেশভাগের দহনগাঁথা তিনি যেভাবে তুলে ধরেছেন তা এক কথায় বিস্ময় জাগানিয়া।

দেশভাগের ফলে বাংলার ভাগ হয়ে যাওয়া তিনি কোনোভাবেই মেনে নিতে পারেননি। ভাগাভাগির সেই সময় ঋত্বিকের বয়স ছিল ২২ বছর। স্বপ্নরঙিন মন ও মননে ছিল ঐক্য ও অসাম্প্রদায়িকতার বাতাবরণ। গড়া, বিনির্মাণের স্বপ্নময়তার সময়েই আসে ভাঙনের কাল। এবং সেটা সম্পূর্ণ রাজনৈতিক কারণে।

আঙ্গিকের ভিন্নতা ছিল রাজনীতিরই কূটচাল। তাই দাবার গুটি হয়ে গেল মানুষ। দেশভাগের উপর নির্মিত শেষ ছবি ‘সুবর্ণরেখা’ (১৯৬৫)-য় সেটাই যেন চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছেন ঋত্বিক। তার এই ছবিকে তাই দেশভাগের সমাজ বাস্তবতার প্রতিচ্ছবি বললে অত্যুক্তি হবে না মোটেই।

সাতপুরুষের ভিটেমাটি ফেলে যাওয়া, নতুন করে জীবন সংগ্রামে নিবিষ্ট হওয়া, তার জন্য প্রতি পদে পদে ঘাত প্রতিঘাতের মুখোমুখি হওয়ার নিরন্তর যে লড়াই এবং অহর্নিশ হাহাকার তাকেই প্রতিপাদ্য করেছেন তিনি। তার ব্যথার ভাষ্য অশ্রুসিক্ত করে দর্শকদের। হৃদয়ে হয় ক্ষরণ। ঝরে পড়া চোখের জল কি শুকিয়ে যায় সঙ্গে সঙ্গে? নিশ্চয়ই না। সেই জল বাঙালির মন ও মননে সময়ে সময়ে সেই প্রশ্নের উদ্রেক করে চলেছে, যে জিজ্ঞাসা জাগরূক করতে চেয়েছিলেন তিনি।

১৯৪৭ সালের দেশভাগ ধরে রাখা কিংবা উপস্থাপনের জন্যই কি দেশভাগের উপর একে একে তিনটি ছবি বিনির্মাণ করেছিলেন ঋত্বিক? আমার মনে হয় ছবি নির্মাণে তার সেই ভাবনা ছিল না মোটেই। তাহলে একটা ছবির মাধ্যমেই তা উপস্থাপন করতে পারতেন তিনি। একের অধিক নির্মাণ করতেন না। নিশ্চয়ই কোনো উদ্দেশ্য সামনে রেখে ছবি নির্মাণে ব্রতী হয়েছিলেন তিনি। তা কী?

আসলে, বিভক্ত সময়ে দাঁড়িয়ে অবিভক্তের অভিলাষ এবং সীমান্তহীন বাঙালিত্বের স্বপ্নের জাল বুনেছেন তিনি। সেই স্বপ্ন যে অলীক নয় এবং সেটা একদিন না একদিন স্পর্শ করবে বাস্তবতার জমিন, সেই ব্যাপারেও গভীর বিশ্বাস ছিল তার। কিন্তু সেটা খোলাসা করেননি কখনো। না বলার মধ্য দিয়ে বলেছেন সেই কথা।

আজ যখন পৃথিবী গ্লোবাল ভিলেজ হয়ে গেছে এবং সেই প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে সীমান্তহীন বাঙালিত্বের যে ঐক্য তৈরি হয়েছে তারই স্বপ্ন ফেরি করে গেছেন ঋত্বিক। বিভাজনের গভীর থেকে গভীরে পৌঁছে তিনি চেষ্টা করেছেন ঐক্যের মালা গাঁথার সূত্র আবিষ্কারের।

দেশান্তরি হওয়া মানুষের জীবন ও মনের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়াগুলো এমনভাবে তুলে ধরেছেন তিনি, যা খুবই মর্মস্পর্শী। কোথাওবা একা, কোথাও দলবদ্ধভাবে, কোথাও পারিবারিক বৃত্তে আবার কোথাও রক্তের সম্পর্কে ভাঙনের যে পরিণতি তিনি বিবৃত করেছেন তা বিভাজনের জন্যই হয়েছে, সেটি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছেন ঋত্বিক।

১৯৪৭ সালের দেশভাগ ধরে রাখা কিংবা উপস্থাপনের জন্যই কি দেশভাগের উপর একে একে তিনটি ছবি বিনির্মাণ করেছিলেন ঋত্বিক? আমার মনে হয় ছবি নির্মাণে তার সেই ভাবনা ছিল না মোটেই…

উদ্বাস্তু শব্দকে মনে প্রাণে ঘৃণা করতেন ঋত্বিক। যে মানুষ হারিয়েছে বাড়ি, সে আর কখনো বাড়ি পায়নি। এপারেও না, ওপারেও না। তাই ভৌগলিক সীমারেখা তাকে সবসময় দিয়েছে পীড়া। খণ্ডিত জীবনের জন্য প্রকারান্তরে পশ্চিমাদেরই দায়ী করেছেন তিনি। তাই পশ্চিমের প্রভাব বলয় মুক্ত চলচ্চিত্র নির্মাণে প্রাধান্য দিয়েছিলেন এবং সেটা তিনি করেছেন নিজস্ব ভাষায়। তাই তার সৃষ্টিগুলো হয়েছে স্বতন্ত্র।

ইতিহাসের কোনো চরিত্র না হয়েও ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করেছেন ঋত্বিক ঘটক। তার শিল্পসত্তা অখণ্ড বাঙালি জাতিসত্তার প্রতি ছিল গভীরভাবে নিবেদিত। সেটা তাকে সবসময় করতো অনুরণিত। সেই কারণেই হয়তো নিজেকে ভাঙা বুদ্ধিজীবীর অভিধায় আখ্যায়িত করতেন তিনি।

ভাঙন থেকেই মানুষ প্রত্যয়ী হয় গড়ার, হতাশা থেকেই জাল বুনে আশার, বিরহ বিতারণ করে খোঁজে নেয় আনন্দের উপলক্ষ, কান্না শেষে হাসে। দুঃস্বপ্ন ভুলে যায় নতুন স্বপ্নের আশায়। ঋত্বিকও সেই পথের অভিযাত্রী হয়েছিলেন। তাই সীমান্তহীন বাঙালিত্বের স্বপ্নের প্রকাশ তিনি ঘটিয়েছেন চলচ্চিত্রে।

তিনি গভীরভাবে বিশ্বাস করতেন, চলচ্চিত্রের মাধ্যমে খুব সহজে পৌঁছে যাওয়া যায় মানুষের মাঝে। আর সব মানুষ যদি, বিশেষ করে বিভাজনের বৃত্তে ঘুরপাক খাওয়া বাঙালিদের মধ্যে যদি সেই স্বপ্ন প্রোথিত করা যায় তাহলে একদিন না একদিন তা লক্ষ্যে পৌঁছবেই। সেটিই হবে তার সার্থকতা।

আজ অগণন বাঙালি তার স্বপ্নের অনুগামী হয়েছে। বিভাজনের বৃত্ত থেকে বেড়িয়ে উজ্জীবিত হচ্ছে ঐক্যের মন্ত্রে। কোনো না কোনোভাবে সেখানে আছেন ঋত্বিক ঘটক। আছে তার দেশভাগের আকুতি, হাহাকার আর বিলাপ।

চেতনাকে শানিত করতে, প্রগতিশীলতা এবং ঐক্যের পথে বাঙালিয়ানাকে প্রবহমান রাখতে তাই বারবার আমাদের ঋত্বিক ঘটকের দ্বারস্থ হতে হবে, নিতে হবে শিক্ষা। এখানেই একজন শিল্প স্রষ্টা হিসেবে তার সার্থকতা। এবং শুধুমাত্র এই একটি কারণে তিনি প্রাসঙ্গিক থাকবেন চিরকাল।- সূত্র: ঢাকা পোস্ট