ঢাকামঙ্গলবার , ৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৩

ভাল নেই পদ্মাপাড়ের জেলেরা

ফেব্রুয়ারি ৭, ২০২৩ ১১:৩৯ পূর্বাহ্ণ । ১১৯ জন

নিজস্ব প্রতিবেদক :
এক সময়ের প্রমত্তা পদ্মানদী জানুয়ারী মাসে এসেই ধুধু বালু চরে পরিণত হচ্ছে। জেগে উঠেছে পদ্মার বিশাল বিশাল চর। অসময়ে শুকিয়ে যাওয়ায় পদ্মায় মাছ শিকার করে জীবিকা নিরবাহ করা জেলেরা এখন আর ভাল নেই। মানবেতর জীবন যাপন করছেন পদ্মাপাড়ের জেলেরা। গত প্রায় দশ বছর থেকে অনেক আগেই পদ্মা শুকিয়ে যাচ্ছে। এতে জাল নৌকার উপর নির্ভর করে চলা জেলেরা সব গুটিয়ে ঘরমুখি হচ্ছেন। পদ্মার পানি শুকিয়ে যাওয়ায় ইতোমধ্যে অনেক জেলে বাপ দাদার পেশা বদল করে ধরেছেন অন্য পেশা। এক সময় পদ্মায় ৮ মাস পানি থাকতো। এতে পদ্মাপাড়ের এক তৃতীয়াংশ মানুষ পদ্মা নদীতে মাছ শিকার করে জীবিকা নিরবাহ করতো। কিন্তু এখন তিন মাস পানি পাওয়া যায় না। তাই জেলের সংখ্যাও অর্ধেকে নেমে এসেছে। এখানো যেসব জেলে পরিবার পদ্মার উপর নির্ভরশীল তাদের সংসারও চলছে খুড়িয়ে খুড়িয়ে।

রাজশাহী জেলা মৎস অফিস সূত্রে জানা যায়, রাজশাহী জেলায় নিবন্ধিত জেলের সংখ্যা ২০হাজার ৬শ’ ৪০ জন। এরমধ্যে পদ্মা নদীতে মাছ শিকার করে জীবিকা নিরবাহ করা জেলের সংখ্যা প্রায় ১৫ হাজার। কিন্তু বর্তমান পদ্মা নদীতে মাছ ধরে জীবিকা নিরবাহ করা জেলের সংখ্যা এসে দাঁড়িয়েছে প্রায় আট হাজারের নিচে। রাজশাহীর পদ্মা নদী মূলত গোদাগাড়ী, পবা, চারঘাট ও বাঘা উপজেলার মধ্য দিয়ে বয়ে গেছে। যার কারণে এই অঞ্চলে জেলে পেশার মানুষের হার বেশি। যদিও পদ্মার পানি ও মাছ সংকটের কারণে পেশার লোকসংখ্যা এখন অর্ধেকেরও নিচে। এখনো যারা জেলে পেশা ধরে রেখেছেন তাদের আর দিন চলে না। পদ্মায় পানি শুকিয়ে যাওয়ায় জেলেরা চাহিদামত মাছ পান না। দিনভর যতটুকু মাছ পান ততটুকু দিয়েই সংসার চালানোর চেষ্টা করেন রাজশাহীর জেলেরা। নানা সংকটের কারণে অনেক জেলে জাল, নৌকা ছেড়ে পেশা বদল করেছেন। ধরেছেন অটোরিকসার হ্যান্ডেল, কেউ বা পারি জমিয়েছেন ঢাকায় আবার অনেকেই হোটেল বয়ের কাজ ও নাইটগার্ডের চাকরি করছেন। বর্তমান এখনো যারা জেলে পেশায় রয়েছেন তাদের অন্য কাজ করার অভ্যাস নেই। বিধায় কষ্ট স্বীকার করে এখনো জেলে পেশা ধরে রেখেছেন।

রাজশাহী পবা উপজেলার নবগঙ্গা গ্রামের জেলে আব্দুল মালেক বলেন, পদ্মা নদীতেই তার ৩৫ বছরের জীবন। ৩৫বছর ধরে তিনি পদ্মায় মাছ শিকার করে জীবিকা নিরবাহ করছেন। তিনি বলেন, বাড়িতে আমার ৯ সদস্যের সংসার। ছেলে মেয়ে বড় করেছেন পদ্মায় মাছ শিকার করে। আগে পদ্মায় সারাবছরই পানি থাকতো মাছও পাওয়া যেতো। এখন পদ্মায় আগের মত পানি থাকে না। এতে মাছও পাওয়া যায় না। তিনি বলেন, পদ্মা বেড়ি বাঁধ থেকে প্রায় ৩ কিলোমিটার দুরে সরে গেছে। জানুয়ারী মাস পড়ার পর সামনের জায়গায় চর জেগে উঠে। এতে মাছ শিকার করতে যেতে হয় শহররক্ষা বাঁধ থেকে প্রায় তিন কিলোমিটার দুরে। তিনি বলেন, সারাদিনে ৫শ’ টাকার মাছ শিকার করতে হিমশিম খেতে হয়। নৌকা, জাল নিয়ে ভোর রাতে আসি, আর বাড়ি ফিরি রাত ৮টায়। এরমধ্যে যে মাছ শিকার করতে পারি তা শহরের মোড়ে বা বাজারে বিক্রি করে বাজার করে বাড়ি ফিরি। তিনি বলেন, আগে পদ্মায় প্রায় ৬ থেকে ৭ মাস পানি থাকতো। তখন অনেক মাছ পাওয়া যেতো। আয় হতো বেশি। কিন্তু এখন পদ্মা অনেক আগেই শুকিয়ে যায়, কাঙ্খিত মাছের দেখা পাই না। যার কারণে অনেক কষ্টে জীবন চালাতে হয়। তিনি বলেন, আগে পদ্মায় ঝাঁকে ঝাঁকে পিওলি, পাঙ্গাস, বাউস, বাঘাইড় মাছ পাওয়া যেতো। এখন বাঘাইড় মাছ চোখেই পড়ে না।

জেলে ফিরোজ বলেন, আমরা মাত্র তিন থেকে সাড়ে তিনমাস ভালভাবে সংসার চালাতে পারি। কারণ ভরা পদ্মায় মাছ শিকার করা যায় না। একটু পানি কমলে মাছ শিকার শুরু হয়। কিন্তু একবার পদ্মার পানি শুকাতে শুরু করলে খুব অল্প সময়ের মধ্যে পদ্মা মরুভুমির মত হয়ে যায়। চৈত্র মাস থেকে জৈষ্ঠ মাস পর্যন্ত আমাদের বসে অবসর সময় কাটাতে হয়। চারঘাটের সুমন জানান, চার মাস আমরা পদ্মায় মাছ শিকার করতে পারি। আর পুরো বছর অনেক কষ্টে দিন পার করতে হয়। সারাদিন যে মাছ শিকার করতে পারি তা বাজারে বিক্রি করে সংসার চালানো অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়।

পবার আয়নাল হক বলেন, বর্তমান বাজারে জাল, নৌকা বা মাছ শিকারের সরঞ্জামাদির দাম বেশি। সাথে বেড়েছে দ্রব্যমূল্যের দামও। মাছের দাম বাড়লেও পদ্মায় চাহিদা মত মাছ না পাওয়ার জন্য জেলে পরিবারগুলোকে মানবেতর জীবন যাপন করতে হয়। তিনি বলেন, ভোর থেকে রাত পর্যন্ত যে মাছ আমরা শিকার করতে পারি তা বিক্রি করে চাল, ডাল বা পরিবারের বাজার হয় না। তিনি বলেন, অন্য কোনো পেশায় কাজ করিনি। যার কারণে এ পেশা ছাড়তে পারি না। জেলে মিনহারুল ইসলাম জানান, সরকার যখন পদ্মায় মাছ ধরা নিষেধ করে তখন জেলেদের কিছু অনুদান দেন। কিন্তু সেই অনুদানও আমরা ঠিক মত পাই না। তিনি বলেন, গতবার ৮হাজার জেলের তালিকা করে চার হাজার জেলেকে ২৪ কেজি করে চাল দেয়া হয়েছে। তারমধ্যে আমরা অনেকেই এই চাল পাইনি। তিনি বলেন, সরকার জেলেদের সাহায্য সহযোগিতা দিলেও সেটি আমরা পাই না। যার কারণে তিন থেকে চারমাস পদ্মায় মাছ শিকার করে ভাল চললেও বাকি সময় টানাপড়েনের মধ্যে সংসার চালাতে হয়। এমনি কথা জানান, জেলে আনু, জহুরুল ও এনতাজুল।

চারঘাট উপজেলার সিনিয়র মৎস কর্মকর্তা ওয়ালি উল্লাহ মোল্লাহ, জেলেরা চারমাস ভাল থাকলেও আট মাস তাদের কষ্টে কাটে। কারণ পদ্মায় আগের মত আর মাছের দেখা মিলে না। তিনি বলেন, আমরা চেষ্টা করি জেলেদের পাশে থাকার।- সিল্কিসিটিনিউজ

রাজশাহী মৎস্য কর্মকর্তা জাহাঙ্গীর আলম বলেন, আমরা চেষ্টা করি সরকারী কোনো অনুদান এলে যারা একান্তই গরিব জেলে তাদের মাঝে বন্টন করা হয়। আমরা জানি পদ্মায় পানি শুকিয়ে যাওয়ার কারণে যারা জাল নৌকা নির্ভর তাদের মানবেতর জীবন যাপন করতে হয়। এরফলে পদ্মা যারা ধ্বংসাত্বক কারেন্টজাল দিয়ে মাছ শিকার করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়ে, প্রকৃত জেলেদের মাছ শিকারের বিষয়টি নিশ্চিত করার চেষ্টা করি।

Paris