গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করা বিশালের (১৫) ময়নাতদন্ত হবে। তাই মর্গের সামনে পাতা ব্রেঞ্চে বসে বাবা বিপ্লব ও তার স্বজনরা। ছেলের মৃত্যুতে নির্বাক বাবা। সঙ্গে থাকা স্বজনরা মর্গে ডোমদের সঙ্গে কথা বলছেন ময়নাতদন্তের বিষয়ে। ডোমরা মৃতের স্বজনদের কাছে ময়নাতদন্তের বিভিন্ন খরচের জন্য টাকা চাইছেন। তবে মৃতের স্বজনদের কাছে দাবির পরিমাণ টাকা না থাকায় পড়েছেন বিড়ম্বনায়।
নিহত বিশালের চাচা শাহিন বলেন, ‘সরকারি হাসপাতাল পোস্টমর্টেম (ময়নাতদন্ত) করতে কেন টাকা লাগবে? সকালে হাসপাতালের লাশ ঘর থেকে মরদেহ বের করার সময় ২০০ টাকা দিয়েছি। তারপরে আরও এক হাজার টাকা দিতে হয়েছে তাকে জিনিসপত্র কেনা বাবদে। এখানে (ময়নাতদন্ত রুমে) আসার পরে আবার টাকা চাওয়া হচ্ছে। তারা (ডোম) বলছে সবমিলে প্রায় ৫ হাজার খরচ হবে। বিশালের বাবা (বিপ্লব) পেশায় রডমিস্ত্রি। দিন এনে দিন খেয়ে সংসার চলে তার। তারা এতোগুলো টাকা কিভাবে দেবে? পরে বাড়িতে কল করা হলে প্রতিবেশী ভাই টাকা দিয়ে গেছেন।
শুধু শাহিনের থেকে নয়, এই মর্গে ময়নাতদন্ত হওয়া সব মৃতের স্বজনদের থেকে টাকা নেন ডোমরা। ময়নাতদন্তের জন্য একটা মৃতের স্বজনের থেকে চার থেকে পাঁচ হাজার করে টাকা নিয়ে থাকেন তারা। টাকা দিতে না পড়লে ডোম ও নিহতের স্বজনদের মাঝে বাকবিতাণ্ডার ঘটনাও নতুন নয়।
জানা গেছে, বর্তমানে মর্গের ময়নাতদন্তের দায়িত্বে আছেন শ্রী তপন ডোম। এই মর্গে চাকরি করতেন তপনের দাদা চঞ্চল দাস। তার মৃত্যুর পরে তারাপদ দাস ডোমের দায়িত্ব পান। তিনি বেতন পেতেন পাঁচ টাকা। তারাপদ দাসের মৃত্যুর পরে ছেলে নিশিপদ দাস বাবার জায়গা কাজে লাগেন। তিনি বেতন পেতেন ২০ টাকা। নিশিপদের মৃত্যুর পরে তার ছেলে অবিনাশ দাস হাতে পান মর্গে চাবি। তিনিও পেতেন একই বেতন। তাদের প্রথমে রাজশাহী সিভিল সার্জন ও পরে জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে বেতন তুলতে হতো। অল্প বেতন হওয়ায় তারা তুলতে যেতেন না। ফলে তাদের সংসার চালতো মৃতের স্বজনদের কাছে হাত পেতে। তবে অবিনাশের মৃত্যুর পরে এখন তপন ডোম ময়নাতদন্তের কাজগুলো করেন। তপন ডোম নন। তিনি হাসপাতালের ক্লিনার পদে নিয়োগপ্রাপ্ত। অবিনাশের মৃত্যুর পরে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ থাকে মর্গে আনেন ডোমের কাজের জন্য।
তপন জানান, বর্তমানে তপন ছাড়াও ময়নাতদন্তের রুমে কাজ করছেন আরও ৮ থেকে ১০ জন। তাদের মধ্যে রয়েছে-বিপন, রনি, সনি, হৃদয়, রঞ্জন, সুমন, মোহন, বাবর, সঞ্জয়। ময়নাতদন্তের প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে তারা সহযোগিতা করে থাকেন। যেমন- হাসপাতাল থেকে কাঁধে করে মরদেহ মর্গ পর্যন্ত নিয়ে আসতে চারজনের প্রয়োজন। যদিও মাঝে মধ্যে ভ্যান ব্যবহার হয়ে থাকে। তারপরেও ভ্যানে উঠানোর জন্যও চারজন লাগে। এছাড়া কাটা, সেলাই করা, মরদেহ উঠা-নামা করা, প্যাকেট করা ইত্যাদি কাজেও লোকবল লাগে। এসব কাজের জন্য চার থেকে পাঁচজন করে দরকার হয়। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মরদেহের নমুনা সংগ্রহ। এগুলো গুরুত্বসহকারে সংগ্রহে লোকবল লাগে। এসব কাজ একা সম্ভব না।
নাম প্রকাশ না করা শর্তে মরদেহ ময়নাতদন্ত কাজে সংশ্লিষ্ট একজন জানায়, ময়নাতদন্তের জন্য যে ছেলেরা কাজ করে, তারা বেতন পান না। তারা কাজ শেষে মৃতের স্বজনদের কাছে টাকার জন্য হাত পাতে। এতে করে মৃতের স্বজনদের সঙ্গে বাকবিতাণ্ডার ঘটনা ঘটে। বিষয়টি তাদেরও (ডোমদের) খারপ লাগে। মানুষ মরেছে, স্বজনরা বেদনায় কাতর। তার মধ্যে টাকা চাওয়া মরার ওপরে খাড়ার ঘা। মৃতের লোকজন তো জানে না, যে ময়নাতদন্ত করতে বিভিন্ন জিনিসপত্র কেনার খরচ আছে। এছাড়া ছেলেরা কাজ করছে তাদের খরচ আছে। অনেক সময় তাদের (নিহতের স্বজনদের) কাছে উপস্থিত টাকা থাকে না। তখন টাকা চাইলে মৃতের স্বজনদের সঙ্গে মনোমালিন্য হয়। টাকা না নিয়ে কী করব? আমাদের তো পেট আছে, সংসার আছে। মৃতের লোকজনের থেকে যে টাকা নেওয়া হয়, পরে টাকাগুলো সবাই ভাগ করে নেয়।- সূত্র: ঢাকা পোস্ট
কয়েজন ডোম বলেন, এখানে যারা কাজ করে তাদের চাকরি নেই। মরদেহের লোকজনের থেকে তারা টাকা উপার্জন করে। তাদের চাকরি থাকলে এটা করতে হত না। তারা মৃতের লোকের থেকে যে টাকা নেয় সেগুলো পাটি, সুতা, দড়ি, সাবানসহ অনেক কিছু কিনতে লাগে। সবাই মনে করে, আমরা সরকারি চাকরি করি। কিন্তু কেউ তো জানে না আমাদের চাকরি নেই। আমরা চাই না, স্বজন হারানো শোকে পাথর কোনো মানুষের কাছে টাকার জন্য হাত পাততে। তাছাড়া সব দিন লাশ আসেও না। কখনো কখনো বসে থাকি।
তপন ডোম বলেন, নিহতের স্বজনদের থেকে নেওয়া টাকায় মর্গের আরও কিছু খরচ মেটানো হয়। যেমন-গ্লাভস, ব্লেড, বয়াম, লবণ, সুতা, গালা, মোম, ম্যাচ, মার্কিন কাপড়, পাটি, পলিথিন ও কিছু মেডিসিন লাগে তার সবই কিনতে হয়। অনেক মরদেহ আসে অজ্ঞাত বা পরিচয়হীন। অভিভাবক থাকে না। আবার যেসব মরদেহের আত্মীয়স্বজন গরিব, তারা কান্নাকাটি করে, টাকা দিতে পারে না। ২০ টাকা বেতনে আমার দাদারা কাজ করেছে। সেই হাল আমার বাবা ধরেছেন। বাবার পরে ভাই কাজ করেছে একই বেতনে। আমাদের রাজশাহী হাসপাতালে ডোম পোস্ট নেই। বিভাগের নাটোর, পাবনা, নওগাঁ, বগুড়াতে ডোম পোস্ট আছে। কিন্তু রাজশাহী বিভাগীয় শহর এতো বড় হাসপাতাল কিন্তু এখানে ডোম নিয়োগ নেই। এখানে প্রতিদিন তিন থেকে চারটি মরদেহের ময়নাতদন্ত করতে হয়। পুরো জেলার মরদেহ এখানে আসে।
রাজশাহী মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ নওশাদ আলী বলেন, আমাদের মেডিকেল কলেজে কোনো ডোম পদ নেই। স্বাধীনতার আগের ২০ টাকা বেতনে ডোমের পদ ছিল। তিনি মারা যাওয়ার পরে আর ডোম পদে নিয়োগ হয়নি। আমাদের অর্গানোগ্রামে নাই। আমরা গত ১০ বছর থেকে চেষ্টা করছি। মৃতের স্বজনদের টাকা নেওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, টাকা নেওয়াকে কেন্দ্রে করে সমস্যার কথা শুনেছি।
হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এফ. এম. শামীম আহাম্মদ বলেন, ‘আমি পাঁচ দিন আগে জয়েন্ট করেছেন। বিষয়টি আমার জানা নেই। তবে খোঁজ খবর নিয়ে দেখব।’