‘১৬-১৭ বছর বয়সে লাশ কাটার ব্লেড ধরেছি। বাবাই (নিশিপদ) ব্লেড হাতে ধরিয়ে দিয়েছিল। এখন আমার বয়স ৫৬ বছর। লাশ কাটার কাজের বয়স ৩৯ বছর। এ সময় ১১ হাজারের বেশি লাশ কেটেছি। একদিনে সর্বোচ্চ ১৭টি মরদেহ ময়নাতদন্ত করেছি। মানুষ হয়ে মানুষকে কাটতে খারাপ লাগে, তার পরও এটাতো কাজ, করতেই হবে।’
কথাগুলো বলছিলেন রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতালে ডোমের কাজ করা শ্রী তপন। তিনি রাজশাহী নগরীর লক্ষ্মীপুর আইডি হাসপাতাল এলাকার বাসিন্দা। গ্রীনসিটি ২৪.কমের প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপকালে তিনি তার কর্মময় জীবনের নানা অভিজ্ঞতার কথা জানান।
ডোমের কাজ শুরুর বিষয়ে তপন বলেন, ডোমের কাজ করেছে দাদা, বাবা, বড় ভাই। এখন আমি করছি, আমার ছেলেও করছে। বাবার সঙ্গে বড় ভাই ডোমের কাজ করতেন। ১২-১৩ বছর বয়সে মর্গে আসতাম। বাবার হাত ধরে আসলেও ময়নাতদন্তের রুমে প্রবেশ করিনি। বয়স অল্প হওয়ায় লাশ দেখে ভয় পেতাম। তখন বাবা নিশিপদ দাস দূরে রাখতেন আমাকে। বলতেন- কাছে আসবি না। তবে বড়দা (বড় ভাই) অবিনাশ ও বাবা লাশ কাটার কাজ করতেন। কোনো কিছুর প্রয়োজন হলে ডাকতেন। কাছে গেলে ময়নাতদন্তের কাজে ব্যবহৃত সুতাসহ বিভিন্ন জিনিস আনতে লক্ষ্মীপুর বা সাহেব বাজারে পাঠাতেন। আর বাকি সময় মর্গের আশ-পাশে বসে থাকতাম।
তবে বয়স বারার সঙ্গে সঙ্গে বাড়তে থাকে সাহসও। আস্তে আস্তে ময়নাতদন্তের রুমের ভেতরে গিয়ে বাবা-দাদার কাজ দেখতাম। তখন তারা (বাবা-বড়ভাই) লাশের হাত বা পা ধরতে বলতেন, ধরতামও। এছাড়া ময়নাতদন্ত শেষে লাশ বাঁধা, সেলাইয়ের কাজ করতে দিতো আমাকে। এইভাবে সাহস হয়ে যায়। এমনভাবে দীর্ঘদিন চলেছে। হালকা-হালকা মনে পরে ১৬ থেকে ১৭ বছর বয়সে বাবা লাশ কাটার ব্লেড হাতে ধরিয়ে দেন। তখন অষ্টম শ্রেণির ছাত্র আমি। প্রথম প্রথম ভয় লাগতো, পরে ঠিক হয়ে যায়। সেই থেকে শুরু লাশ কাটা, এখনও চলছে।
এক দিনে কত লাশ কেটেছেন- এমন প্রশ্নের জবাবে তপন বলেন, এটা ঠিক করে বলা যাবে না। কোনো দিন লাশ থাকে, আবার কোনো দিন থাকে না। কোনো কোনো দিন চার থেকে পাঁচটা লাশও কাটতে হয়। এই যে দুই বছর আগে রাজশাহীর কাটাখালীতে মাইক্রোবাসে ১৭ জন পুড়ে মারা যায়। সেই ১৭ জনের ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ করতে হয়েছে আমাকে। তাদের দাঁত, চুল ও হাড় সংগ্রহ করা হয়। সেদিন আমার মাথা ঘুরে গেছে। এক সঙ্গে ১৭টা লাশের মধ্যে কাজ করছি। আমার জীবনের সর্বোচ্চ ময়নাতদন্তের ঘরের লাশ নিয়ে কাজ করার ঘটনা এটি। এছাড়া দিনে ৯ থেকে ১০টা লাশের ময়নাতদন্ত করেছি। প্রতিমাসে গড়ে ২৫টি লাশ ময়নাতদন্ত করতে হয়। ৩৯ বছর কাজের বয়সে ১১ হাজারের বেশি লাশের ময়নাতদন্ত করেছি।
একটি মরদেহ ময়নাতদন্ত করে কত টাকা পান ডোম
রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মৃতের ময়নাতদন্তের পর স্বজনদের থেকে বহুদিন থেকে টাকা নিয়ে আসছেন ডোমরা। ডোমদের দাবি- এটা তাদের চাকরি না। এছাড়া তারা হাসপাতাল থেকে বেতন পান না। ফলে ময়নাতদন্ত শেষে মৃতের স্বজনদের থেকে তারা যে টাকা নেন তা দিয়ে তাদের সংসার চলে।
এ বিষয়ে তপন গ্রীনসিটি ২৪.কমকে বলেন, এখানে লাশ আনা-নেওয়া থেকে শুরু করে চার থেকে পাঁচজন কাজ করে। তাদের কিছু কিছু করে হলেও টাকা দিতে হয়। একটা লাশ কাটার পরে সর্বনিম্ন চার থেকে পাঁচ হাজার টাকা নেওয়া হয়। এই টাকার বড় অংশ ব্লেড, বয়াম, লবণ, সুতা, গালা, মোম, ম্যাচ, মার্কিন কাপড়, পাটি, পলিথিন ও কিছু মেডিসিন কিনতে খরচ হয়। তাহলে আর কতটা থাকে। লাশ কাটার পরে কেউ কেউ বেশিও দেয়। এমনও আছে অনেক গরিব। টাকা দিতে পারে না। অনেক সময় বেওয়ারিশ লাশ আসে। সেই লাশগুলোর ময়নাতদন্ত শেষে টাকা পাওয়া যায় না। শুধু থানা থেকে মাত্র এক হাজার টাকা দেয়। সেই টাকা আমরা ভাগ করে নিই।
মরদেহ ময়নাতদন্তের জন্য মাদক গ্রহণ
মরদেহ ময়নাতদন্তের জন্য ডোম কি মাদক গ্রহণ করে? এমন প্রশ্ন অনেকেরই। অনেকেই ভাবেন মানুষ হয়ে মানুষের শরীর কাটবে, সুস্থ অবস্থায় সম্ভব না। অনেকেই বলেন, নেশার ঘোরে ডোমরা মরদেহ ময়নাতদন্ত করেন।
এ বিষয়ে তপন বলেন, না, মরদেহ কাটতে নেশা করার দরকার হয় না। আমি ময়নাতদন্তের ঘরে প্রবেশ করলে নেশা করি না। নেশা না করলে সমস্যা হয়।
উদাহারণ দিতে গিয়ে তপন বলেন, অনেক সময় হাত-পা ফ্যাক্চার হলে চিকিৎসকরা ড্রেসিং করেন। রক্ত, ময়লা পরিষ্কার করেন। তারা কি নেশা করেন? করেন না। তেমনই লাশ কাটাও প্রায় একই কাজ। নেশা করার প্রয়োজন হয় না।
তপন ডোম বলেন, বাবা-দাদারা ওই সময় (অনেক আগে) একটু নেশা করতো। নেশা করলে একটু মেন্টালিভাবে রিল্যাক্স লাগে। একসঙ্গে তিন থেকে চারটা মরদেহ কাটবে, একটা ভয়-ভীতির ব্যাপার থাকে। সেই জায়গা থেকে একটু নেশা করতো। তবে মরদেহ কাটতে নেশা করা লাগে এটা ভুল কথা।
রাত-বিরাতে ময়নাতদন্তের জন্য ডাক
ময়নাতদন্তের জন্য হঠাৎ ডাক পাওয়ার বিষয়ে তপন বলেন, আমাকে অনেক দিন গভীর রাতে পুলিশ বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে এসেছে। পুলিশের গাড়িতে এসে লাশ ময়নাতদন্তের রুমে ঢুকিয়ে দিয়ে গেছি। কোনো দিন পুলিশ বাড়িতে রেখে এসেছে। আবার কোনো কোনো দিন আমি একই বাড়িতে ফিরে গেছি। গত বৃহস্পতিবার (২ ফেব্রুয়ারি) একজন আদিবাসী গলায় ফাঁস দিয়ে মারা গেছে। তার লাশ রাত ১১টার দিকে ময়নাতদন্তের রুমে ঢুকিয়ে দিয়ে বাড়িতে গেলাম। পরের দিন ময়নাতদন্ত করলাম। আগে হঠাৎ করে কল (ডাক) আসতো বেশি। শুধু আমরা থাকলে ময়নাতদন্ত হবে বিষয়টি তা নয়। চিকিৎসকও লাগে ময়নাতদন্তের সময়। কিন্তু এখন একটা নিয়মের মধ্যে নিয়ে আসা হয়েছে। এখন দুই ভাগে ময়নাতদন্ত হয়। সকালেরগুলো দুপুরের মধ্যে। আর দুপুরের গুলো বিকেলের মধ্যে ময়নাতদন্ত করা হয়। আগে এই নিয়ম ছিল না। আগে রাতভর ময়নাতদন্তের কাজ করতে হতো।
ময়নাতদন্তের সময় ভয়
ময়নাতদন্তের সময়ে ভয় লাগার বিষয়ে তপন বলেন, অনেক সময় পচা, গলা বা ফোলা লাশ আসে। জিহ্বা, চোখ বের হয়ে গেছে। সেগুলো প্রথম প্রথম দেখে ভয় লাগতো। অনেক সময় লাশ কাটা ঘরে একা একা কাজ করলে ভয় লাগতো। ছোটবেলা একবার ফোলা লাশ দেখে ভয় পেয়ে গিয়ে ছিলাম। দৌড়ে পালিয়ে বাইরে গিয়েছিলাম। তারপর তপন ১০ থেকে ১৫ দিন আর মর্গের আশপাশে আসেনি।
আগে রাতে যখন কাজ করতাম। ময়নাতদন্তের সময় বিদ্যুৎ গেছে অনেক দিন। সেই সময় মোমবাতির আলোতে লাশ কাটার কাজ করেছি। বড় ভাই অবিনাশ বেঁচে ছিল। বাগমারার একজন বিষপানে মারা যাওয়া মানুষের ময়নাতদন্তের জন্য হাসপাতালে নিয়ে এসেছে। যদিও তাকে দুপুরের দিকে নিয়ে আসা হয় মর্গে। কাজ করতে করতে সন্ধ্যা হয়ে গেল। তখন তো মর্গের পাশে তেমন লোক থাকতো না। স্বজনরাও অনেক দূরে থাকতো। সেদিন রাতে বড় ভাই অবিনাশ আর আমি কাজ করছিলাম। লাশ কাটা শেষ হয়েছে। এখন শুধু সেলাইয়ের কাজ বাকি। বড় ভাই অবিনাশ বলেন- তুই লাশটা সেলাই কর। বড় ভাই বললো আমি একটু আসছি। একাই কাজ করছি। হঠাৎ বিদ্যুৎ চলে যায়। তখন ভয় পেয়ে যাই। দৌড়ে বাইরে পালিয়ে যাই। বিদ্যুৎ যাওয়ায় বড় ভাই অবিনাশও দ্রুত ছুটে আসেন মর্গের দিকে। এসে দেখেন আমি বাইরে দাঁড়িয়ে আছি। আমাকে বলল তুই বাইরেই থাক। আমি মোমবাতি জ্বালিয়ে সেলাই করি। আমি আর মর্গে ঢুকিনি সেই রাতে।
ডোমের কাজে উঠতি বয়সের ছেলেরাও
তপন বলেন, আমরা বংশ পরম্পরায় ডোমের কাজ করি। দাদা, বাবা, বড় ভাইয়ের পরে এখন আমি কাজ করি। বর্তমানে ডোম ঘরে লাশ নাড়াচাড়া করে ১৯ থেকে ২৫ বছর বয়সের ছেলেরা। বিপন, রনি, সনি, হৃদয়, রঞ্জন, সুমন, মোহন, বাবর, সঞ্জয় কাজ করে। তারা তো (ছেলেরা) বেকার। লাশ কাটার সঙ্গে থাকলে কিছু টাকা পায়। তাই ছেলেরা লাশের কথা শুনলেই চলে আসে। এটাতে কি তাদের জীবন চলবে? না পেট চলবে। কয় টাকাই পায় তারা। একটা লাশ কাটলে সর্বোচ্চ ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা পাবে। বিভিন্ন খরচ বাদ দিয়ে ভাগাভাগি করে নিতে হয় টাকা। তারপরও তারা কাজ করে। এই কাজকে বাঁচাতে রাষ্ট্রীয়ভাবে পদক্ষেপ গ্রহণ করা দরকার। এই সম্প্রদায় চলে গেলে এখানে কেউ কাজ করতে পারবে না। এখানে ডোম নিয়োগ খুবই জরুরি।
ডোমের কাজ পরিবার ও সমাজ কীভাবে দেখে
এ বিষয়ে তপন বলেন, তেমন সমস্যা হয় না। সমাজের মানুষ কাজ হিসেবে দেখে। আর পরিবারও অভ্যস্ত হয়ে গেছে। কাজ শেষে গেলে বাইরে দাঁড়িয়ে সাবান দিয়ে গোসল করে পরিষ্কার হয়ে ঘরে ঢুকতে হয়। সেই কারণে পুরোনো মর্গের পাশে নিজে পরিষ্কার হওয়া ও জামা-কাপড় ধোয়ার জন্য পানির ব্যবস্থা করা হয়েছে। সেখানে পরিষ্কার হয়ে বাড়িতে যাই।
ডোম সমাজের সভাপতি শ্রী দীপন জানান, তাদের দাদা-বাবারা এই কাজ করতেন। এখন তারা এই কাজ করছেন। ডোমেরা হাসপাতাল থেকে কোনো ধরনের সুযোগ-সুবিধা পান না। বর্তমানে রাজশাহী মেডিকেলে তপনসহ ময়নাতদন্তের রুমে কাজ করছেন ৮ থেকে ১০ জন। তারা শুধু ডোমের কাজই করেন। অন্য কাজ করেন না।
রাজশাহী মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ ডা. নওশাদ আলী বলেন, ডোমদের হাসপাতাল থেকে কোনো টাকা দেওয়া হয় না। তারা তো নিয়োগপ্রাপ্ত নয়, তাই তাদের সরকারি টাকা দেওয়ার সুযোগ নেই।