সাংবাদিকদের তিনটি দল ভিন্ন ভিন্ন দেশের ক্লায়েন্টের ছদ্মবেশে ছয় মাসেরও বেশি সময় ধরে চেষ্টার পর ইসরায়েলি প্রতিষ্ঠান টিম জর্জের প্রধান তাল হানানের মুখোশ উন্মোচন করতে পেরেছেন; যিনি ৩০টিরও বেশি দেশের নির্বাচনে হস্তক্ষেপ করেছেন হ্যাকিং, অপকর্ম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে গুজব ছড়ানোর মাধ্যমে।
সাংবাদিকদের যে ৩টি দল অত্যন্ত সতর্ক ও ধূর্ত এই ব্যক্তির কার্যক্রম উন্মোচন করেছে, তারই একটি দলের এক সদস্য তাল হানানের সঙ্গে তাদের সাক্ষাতের বিবরণ দিয়েছেন ব্রিটেনের দৈনিক দ্য গার্ডিয়ানকে।
গার্ডিয়ানের প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত ডিসেম্বরের শেষের দিকে ইসরায়েলে টিম জর্জের কার্যালয়ে তাল হানানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন তিনজন সাংবাদিকের একটি প্রতিনিধি দল। সাংবাদিকদের এই দলে ছিলেন ইসরায়েলের দৈনিক দ্য মার্কারের সাংবাদিক গুর মেগিডো, রেডিও ফ্রান্সের সাংবাদিক ফ্রেডেরিক মেটেজিউ এবং ইসরায়েলের সবচেয়ে পুরোনো দৈনিক হারেৎজের সাংবাদিক ওমের বেনজ্যাকব। প্রায় ছয় মাস ধরে চেষ্টার পর তাল হানানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে সক্ষম হন তারা।
তাল হানানের ছদ্মনাম জর্জ। যে প্রতিষ্ঠানটি তিনি পরিচালনা করেন, তার নাম টিম জর্জ। ৫০ বছর বয়সী ইসরায়েলি স্পেশাল ফোর্সের এই সাবেক কর্মকর্তা টিম জর্জ নামের বিশাল একটি দলকে নেতৃত্ব দিয়ে আসছেন, যে দলটি বিভিন্ন দেশের নির্বাচনে গোপনে কারসাজি করে আসছে।
সাংবাদিকদের আন্তর্জাতিক একটি কনসোর্টিয়ামের প্রতিনিধি গুর মেগিডো, ফ্রেডেরিক মেটেজিউ এবং ওমের বেনজ্যাকব জর্জ ওরফে তাল হানানের সঙ্গে সাক্ষাতের ব্যাপারটিকে তাদের অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ মিশন হিসাবে নিয়েছিলেন। আফ্রিকার একটি বৃহৎ ও অস্থিতিশীল দেশের এক ব্যবসায়ীর প্রতিনিধি হিসেবে ছয় মাস কয়েকবার অনলাইনে জুম বৈঠক করেন তারা। বৈঠকের মূল বিষয়বস্তু ছিল দেশটির জাতীয় নির্বাচনে কারসাজি করা।
অনলাইন সেসব বৈঠকের প্রতিটিতেই জর্জ তার জুম ক্যামেরা বন্ধ রেখেছিলেন। ফলে অনলাইনে তার কণ্ঠস্বর শোনা গেলেও চেহারা দেখা যায়নি।
অবশেষে জর্জ ওরফে তাল হানানের আমন্ত্রণে গত ডিসেম্বরের শেষ দিকে টিম জর্জের কার্যালয়ে যান তারা। দ্য গার্ডিয়ানের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, তার কার্যালয়ের সামনে প্রতিষ্ঠানটির নাম এবং লোগো সংক্রান্ত কোনো সাইনবোর্ড দেখতে পাননি তারা।
আফ্রিকান ব্যবসায়ীর প্রতিনিধির ছদ্মবেশে থাকা তিন সাংবাদিক টিম জর্জের কার্যালয়ে প্রবেশের কিছুক্ষণ পর দুই সহকারীকে নিয়ে তাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে আসেন জর্জ, ওরফে তাল হানান। দেখতে বেশ চটকদার, স্মার্ট পোশাক ও দামী হাতঘড়ি পরা হানান সাংবাদিকদের সঙ্গে করমর্দনের পর প্রথমেই বলেন, ‘আপনারা দরজার বাইরে কোনো সাইনবোর্ড বা লেখা কি দেখতে পেয়েছেন?’
সাংবাদিকরা না সূচক উত্তর দেওয়ার পর হানান বলেন, ‘আমাদের দরজার বাইরে কিছু লেখা নেই, কিছুই নেই। আমরাও কিন্তু তেমনি; আমাদের কোনো পরিচয় নেই, আমরা কেউ নই।’
সাক্ষাতে তাল হানান নিজেই গর্বের সঙ্গে জানান, হ্যাকিং ও গুজব ছড়ানোর মাধ্যমে ৩০টিরও বেশি দেশের নির্বাচনে হস্তক্ষেপ ও কারসাজি করেছে তার প্রতিষ্ঠান টিম জর্জ।
সাংবাদিকদের এই প্রতিনিধি দলের অন্যতম সদস্য মেগিডো দ্য গার্ডিয়ানকে বলেন, নিজের এক সোর্সের মাধ্যমে তিনি জানতে পেরেছিলেন— ইসরায়েলের মোডি’ইন এলাকায় টিম জর্জের কার্যালয়। তবে সেই কার্যালয়ের কোনো নাম নেই।
‘এবং আমাদের গোটা অনুসন্ধান কার্যক্রমে ওই প্রতিষ্ঠানের যতজন কর্মীর সঙ্গে আমরা কথা বলেছি, কেউই একবারের জন্যও নিজেদের নাম বলেননি।’
পেশাজীবীদের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম নেটওয়ার্ক লিঙ্কডইনে অ্যাকাউন্ট আছে হানানের। লিঙ্কডইনে নিজেকে ব্যবসায়ী হিসেবে উল্লেখ করেছেন তিনি। ২০০৬ সালে মার্কিন সংবাদমাধ্যম ওয়াশিংটন পোস্ট তাদের এক প্রতিবেদনে তাল হানানকে নিরাপত্তা ও বিস্ফোরক বিশেষজ্ঞ হিসাবে উল্লেখ করেছিল।
গুর মেগিডো জানান, গত দু’দশকেরও বেশি সময় ধরে অর্থের বিনিময়ে বিভিন্ন দেশের জাতীয় ও আঞ্চলিক নির্বাচনে কারসাজি করে আসছেন হানান। বেশ কয়েকটি ই-মেইল অ্যাকাউন্ট ও মোবাইল সিমের মাধ্যমে নিজের ক্লায়েন্টদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখেন তিনি। এসব ই-মেইল অ্যাকাউন্ট ও মোবাইল সিমের সবই ইন্দোনেশিয়ায় নিবন্ধিত।
‘তবে ব্যাপক সতর্ক হওয়া সত্ত্বেও তিনজন অনুসন্ধানী সাংবাদিক যে ছদ্মবেশে জর্জ ওরফে হানানের তৎপরতা সম্পর্কে তথ্য নিচ্ছেন, তা ঘুণাক্ষরেও ধারণা করতে পারেননি তিনি। যদি পারতেন তাহলে প্রথম বৈঠকে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী রজার নরিয়েগার সঙ্গে তার সুসম্পর্কের ব্যাপারে আমাদের কিছু বলতেন না,’ দ্য গার্ডিয়ানকে বলেন গুর মেগিডো।
যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশের নেতৃত্বাধীন প্রশাসনের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী রজার নরিয়েগা নিজ দল কনজারভেটিভ পার্টির সবচেয়ে রক্ষণশীল ঘরানার নেতাদের অন্যতম।
দেশটির রাজধানী ওয়াশিংটন ডিসিতে ‘ভিশন আমেরিকাস’ নামে একটি থিংকট্যাংক সংস্থা আছে নরিয়েগার। ইসরায়েলে নিজ কার্যালয়ে আন্ডারকভার সাংবাদিকদের সঙ্গে বৈঠকের সময় তাল হানান জানান, ভিশন আমেরিকাস তার একটি জীবনী প্রকাশ করেছে এবং তাকে সংস্থার অন্যতম সহযোগী হিসেবেও স্বীকৃতি দিয়েছে।
সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে হানান আরো জানান, যুক্তরাজ্যভিত্তিক কনসালটেন্সি প্রতিষ্ঠান কেমব্রিজ অ্যানালেইটিকার সঙ্গে ও যোগাযোগ ছিল তার। বর্তমানে এই প্রতিষ্ঠানটি বিলুপ্ত।
হানানের দাবি সম্পর্কে নিশ্চিত হতে ক্যামব্রিজ অ্যানালিটিকার সাবেক শীর্ষ নির্বাহী আলেক্সান্ডার নিক্সের সঙ্গেও যোগাযোগ করেছিল দ্য গার্ডিয়ান। নিক্স হানানের সঙ্গে তার সংস্থার যোগাযোগ ও সংশ্লিষ্টতার ব্যাপারটি স্বীকারও করেছেন।
নিক্স বলেন, ‘তিনি কেমব্রিজ অ্যানালেইটিকার সঙ্গে যোগাযোগ করার পর আমি আমার সাবেক এক সহকর্মীর কাছে তার সম্পর্কে জানতে চেয়েছিলাম। তাৎক্ষণিকভাবে সেই সহকর্মী কোনো উত্তর দেননি…একদিন পর তিনি জানালেন, তাল হানান হলো আন্তর্জাতিক দানব সংস্থার শীর্ষ নির্বাহী।- ঢাকা পোস্ট