এক সময়ের কীর্তিনাশা পদ্মা এখন ধু ধু বালুচর। নির্দিষ্ট কয়েক মাস পানিতে পরিপূর্ণ থাকলেও বছরের সিংহভাগ সময় পানি না থাকার ফলে ক্ষেত খামারে পরিণত হয়েছে পদ্মা নদী। আগে যেখানে পদ্মাপাড়ের মানুষের জীবন-জীবিকার উৎস ছিল নদী, নৌকা আর মাছ, সেখানে এখন তাদের জীবন-জীবিকা চলছে ক্ষেত খামারে চাষাবাদ করে। নির্দিষ্ট সময় ছাড়া পদ্মার রাজশাহী পয়েন্টের এমন পানিহীন অবস্থা বহু বছর ধরে।
সরেজমিনে পদ্মা নদীতে গিয়ে দেখা যায়, মাঝ নদীতে চর জেগেছে। ফলে পানি প্রবাহের ধারা কয়েকভাগে বিভক্ত হয়েছে। নদীজুড়ে কোথাও পানি, আবার কোথায়ও ধু ধু বালু চর। চরগুলোতে বিভিন্ন ফসল ফলানো হচ্ছে। একই সঙ্গে লালন পালন করা হচ্ছে গবাদিপশু। তবে নদীতে পানি না থাকার কারণে যাতায়াত নিয়ে দুর্ভোগে পড়তে হয় চরবাসীদের। চরের মানুষগুলোর নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস ছাড়াও চিকিৎসার কাজে যেতে হয় রাজশাহী শহরে। তাদের যাতায়াতের একমাত্র মাধ্যম নৌকা। তবে নদীতে পানি কম থাকায় পায়ে হেঁটে চলাচল করতে হয় তাদের।
চরখিদিরপুর এলাকার বাসিন্দা আবু সামা (৬০)। তিনি নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের জন্য কখনো নৌকা আবার কখনো পায়ে হেঁটে যান রাজশাহী নগরীতে। তিনি বলেন, চরে কোনো হাট-বাজার নেই। তবে কিছু দোকান রয়েছে। সেগুলোতে চাহিদা মতো জিনিসপত্র পাওয়া যায় না। তাই রাজশাহীতে যেতে হয় আমাদের। সবচেয়ে ভালো হয় নদী ভরা থাকলে। তখন পায়ে হাঁটতে হয় না। পদ্মা গার্ডেনের খেয়া ঘাট থেকে নৌকায় চড়লে খিদিরপুর ঘাটে গিয়ে নামা যেতো সহজে। কিন্তু এখন নদীতে পানি নাই। তাই অনেক ঘুরে মাঝি নৌকা নিয়ে যায়। এর পরও পায়ে হাঁটতে হয় আমাদের।
নৌকার মাঝি রুমন বলেন, নদীতে পানি কম। পানি কম থাকার কারণে নৌকা নিয়ে অনেক ঘুরে যেতে হয়। এতে সময়ও বেশি লাগে, খরচও বেশি হয়। আগের মতো নৌকায় আয় হয় না। আগে দিনে চার থেকে পাঁচবার যাওয়া আসা করতাম। এখন কমে গেছে। রমজানের শুরু থেকে মানুষ তেমন পারাপার হচ্ছে না। তবে ঈদের আগে মানুষ পারাপার বাড়বে।
নদী ভাঙনে সর্বস্বান্ত হওয়া সাজেদা বেগম (৫৫)। তবুও তিনি নদীপাড়ের বাসিন্দা। সাজেদার জন্মস্থান ছিল চরখিদিরপুরে। নদী ভাঙনের কারণে ঘর-বাড়ি ছেড়ে বাবা মাসহ আশ্রয় নিয়েছেন নগরীর সাতবাড়িয়া এলাকায়। নিজ চোখে দেখেছেন পদ্মার ঢেউ, শুনেছেন গর্জন। এখন দেখছেন পানিহীন মরা পদ্মা। সাজেদা বেগম ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘বর্ষার সময় বড় বড় ঢেউ। তখন নৌকাতে মানুষ মাছ ধরতো। সেই মাছ বিক্রি করি জ্যালিরে (জেলেদের) প্যাট (পেট) চলতো। এখন আর সেই গাং (নদী) নাই। উল্টাপাল্টা হয়ে গেছে। ৩০-৩৫ বছর আগে গাংগে সব সুমাতিই (সময়) পানি থ্যাকতো। ভরা গাং দেখি বড় গাং মুনে হতো। গাং ভাঙ্গি-গড়ি, পাল্টে গেছে। মেলা মানুষের চটিপটি গোল হ গেছে (সব হারিয়ে গেছে)। আমরাও চরখিদিরপুর থেকে গাং ভাঙনের ঠেলায় পাল্লে অ্যাসিছি (ভাঙ্গনের কারণে পালিয়ে এসেছি)। গাংগে আর যাওয়া হয় না। এখন বাপও নাই, মাও নাই। সব ভাঙ্গিচুরি লি (নিয়ে) এপারে চলি অ্যাসিছি।’
চরের মানুষের অর্থনীতি
বছরের আড়াই থেকে তিন মাস পদ্মায় ঠিক মতো পানি থাকে। বাকি সময় ধু ধু বালুচর। এই বালু চরে প্রায় ১৩ ধরনের ফসলের আবাদ হয়। মসুর, গম, সরিষা, বিভিন্ন ধরনের শাকসবজি ছাড়াও ভুট্টা, বোরো ধান ও পেঁয়াজের চাষাবাদ হয়। বিশাল এই চাাঁবাদের সঙ্গে চরের অনেক মানুষ জড়িত। তারা সাধারণত কৃষির ওপর নির্ভরশীল। আর নদীতে পানি থাকলে মাছ ও নৌকা চালিয়ে আয় হয় তাদের। অনেকেই আবার রাজশাহী শহরে বিভিন্ন কাজ করেন। এছাড়া অনেকেই আবার বিভিন্ন গবাদিপশু পালন করে থাকেন। সেই পশু বিক্রি করেও চলে তাদের জীবন-জীবিকা।
চরে প্রায় ২০ বিঘা জমিতে মসুরের চাষ করেছেন মো. সাগর। তিনি অন্য বছরের মতো চলতি বছরও ভালো ফলন হয়েছে তার চাষ করা মসুরের। কম খরচে মসুর চাষ করে ভালো ফলন পাওয়ায় খুশি তিনি।
অপর চাষি নজরুল ইসলাম বলেন, চরে ফসল করায় কিছু প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। এর মধ্যে একটি গবাদিপশু। চরে প্রচুর গবাদিপশুর উৎপাত। রাখালেরা গরু, মহিষ, ভেড়া ছেড়ে দিয়ে রাখে। তখন ফসলগুলো নষ্ট হয়। এছাড়া তেমন সমস্যা নেই। এর মধ্যে যারা গম ও ভুট্টা চাষ করে, তাদের সেচ দিতে হয়। জমির কাছাকাছি পানি না থাকলে দূর থেকে মেশিনের মাধ্যমে সেচ দিতে হয়। এতে করে খরচ কিছুটা বেড়ে যায়। তারপরেও লাভ আছে।
রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর বলছে, রাজশাহী জেলার আওতায় পদ্মার ১৪টি চর রয়েছে। এ চরের আয়তন ১৪ হাজার ৮৫৩ হেক্টর। যার মধ্যে আবাদি জমির পরিমাণ ১০ হাজার ১৮৭ হেক্টর। এর মধ্যে মসুর চাষ হয়েছে ১ হাজার ৫২৫ হেক্টর, গম চাষ হয়েছে ২ হাজার ৬৯৫ হেক্টর, সরিষা চাষ হয়েছে ৩৫০ হেক্টর, শাকসবজি চাষ হয়েছে ১ হাজার ৫৮০ হেক্টর, ভুট্টা চাষ হয়েছে ৬২৫ হেক্টর, বোরো ধান চাষ হয়েছে ৫৫০ হেক্টর, পেঁয়াজ চাষ হয়েছে ৫১০ হেক্টর, রসুন চাষ হয়েছে ৫৫০ হেক্টর, আলু চাষ হয়েছে ৪৮৫ হেক্টর, আম চাষ হয়েছে ৩৪০ হেক্টর, মাসকালাই চাষ হয়েছে ৭২৭ হেক্টর, চিনা বাদাম চাষ হয়েছে ২০০ হেক্টর ও ধনিয়া পাতা চাষ হয়েছে ৫০ হেক্টর জমিতে।
জাল, জেলে ও পানি
রাজশাহী জেলায় রয়েছে প্রায় ১৮ হাজার জেলে। এর মধ্যে শুধু পদ্মা নদীকে কেন্দ্র করে ১২ হাজার নিবন্ধিত জেলে রয়েছে। নদীতে পানি না থাকায় এই জেলেদের বিকল্প হিসেবে জীবিকার তাগিদে অন্য কাজ বেছে নিতে হয়। তাদের মধ্যে একজন আলী হোসেন। তিনি রাজশাহী নগরীর মিজানের মোড়ের বাসিন্দা। পদ্মায় মাছ ধরে জীবিকা চললেও এখন পানি না থাকায় বাধ্য হয়ে অটোরিকশা চালাচ্ছেন তিনি।
আরেক জেলে আলমগীর হোসেন। তিনিও পদ্মায় মাছ ধরেন। বর্তমানে নদীতে পানির অভাবে মাছ না থাকায় জীবিকার তাগিদে চাউলের আড়তে কাজ করছেন তিনি। কয়েক মাস আগেও পদ্মা থেকে ২২ কেজি ওজনের কাতলা মাছও ধরেছেন আলমগীর। তিনি জানান, পদ্মায় পানি কম। যেসব এলাকায় মাছ হয়, সেসব এলাকায় পানি নেই বললে চলে। তাই মাছও পাওয়া যাচ্ছে না। এখন চালের আড়তে কাজ করছি।
রাজশাহী জেলা মৎস কর্মকর্তা জাহাঙ্গীর আলম জানান, রাজশাহী জেলায় ১৮ হাজার জেলে রয়েছে। এর মধ্যে শুধু পদ্মা নদীকে কেন্দ্র করে নিবন্ধিত জেলে রয়েছে ১২ হাজার। নদীতে পানি না থাকায় এই জেলেদের বিকল্প হিসেবে জীবিকার তাগিদে অন্য কাজ বেছে নিতে হয়েছে। নদী এখন শুকনা। এছাড়া নদী দূষণ ও মা মাছ নিধনের মতো নানা কারণে নদীতে মাছের অভাব দেখা দিয়েছে।
রাজশাহী পানি উন্নয়ন বোর্ডের পানি পরিমাপক (গেজ রিডার) এনামুল হক বলেন, রাজশাহী নগরীর টি-বাধ পয়েন্টে পদ্মার পানি মাপা হয়। ১ এপ্রিল পানি ছিল ৮ দশমিক ৮ মিটার। তার আগের দিন ৩১ এপ্রিল ছিল ৮ দশমিক ১২ মিটার। তিনি বলেন, পদ্মার রাজশাহী অঞ্চলে ২০ মে থেকে পানি বাড়তে থাকে। আগস্ট, সেপ্টেম্বর ও অক্টোবরে পদ্মায় ভরা পানি থাকে। আবার নভেম্বর মাসের শেষের দিকে পানি কমতে থাকে।
বিস্তীর্ণ চরে গবাদিপশু পালন
পদ্মার বিস্তীর্ণ চরজুড়ে নানা প্রজাতির গবাদিপশু পালন করা হয়। চরের প্রতিটি বাড়িতে গরু, মহিষ, ছাগল না থাকলেও হাঁস-মুরগি রয়েছে। হাঁস-মুরগি পালন করে চরের মানুষ নিজেদের চাহিদা মিটিয়ে রাজশাহী নগরীতেও বিক্রি করেন। একইভাবে গরুর দুধও বিক্রি হয় নগরীতে।
পদ্মার চরে গেলেই দেখা মিলবে গরু, মহিষ ও ভেড়ার একেকটি বড় বড় পাল। একেকটি পালে সাড়ে ৩০০ থেকে ৪০০টির অধিক গবাদিপশু থাকে। সেগুলো মাঠে চড়াতে তিন থেকে পাঁচজন রাখাল প্রয়োজন হয়। সেরকমই একজন পবা চরখিদিরপুরের রেজাউল ইসলাম (৪২)। তিনি ছাড়াও পদ্মার চরে গরু, মহিষ, ভেড়াকে খাবার খাওয়াতে নিয়ে এসেছেন নাসিম ও শহিদ। তারা তিনজনে ছয়জন মালিকের ১৫০টি গরু, ৬০টি ভেড়া ও ৩টি মহিষ দেখাশোনা করেন।
রেজাউল ইসলাম বলেন, ‘১০ বছর বয়স থ্যাকি এই কাজ করছি। এখন বয়স ৪২ বছর। আগে বাপ, চাচারা এই কাজ করতো। এখন আমরা করি। গরু চড়ানোই আমাদের কর্ম। ছোটবেলা থ্যাকি এডিই কর্ম। যখন যে মাঠে ঘাস, তখন সেই মাঠে লিয়ে যাই। চরখিদিরপুর গ্রামে বাড়ি। আর আরেক গ্রামে গরু চড়াই। এই মাঠে কিছুদিন চড়াবো, তারপরে অন্য মাঠে লিয়ে যাব। এর মধ্যে আবার বন্যা হয়ে গ্যালে তখন আবার অন্য মাঠে লিয়ে যাব। ওই মাঠে মাঠে ব্যাড়াতে হয়।
অপর রাখাল নাসিম জানান, জন্ম হয়েছে পদ্মার চরে। বেড়ে ওঠাও পদ্মা চরে। জীবন-জীবিকাও এখানে। পদ্মার চরে বাথান বাড়ি (অস্থায়ী থাকার ঘর) করে রাত কাটান তারা। তারা নিজেরাই রান্না করেন। কোনো কোনো সময় বাড়ি থেকে তাদের খাবার আসলেও অধিকাংশ সময় তাদের রান্না করে খেতে হয়। সারাদিন গরু-মহিষ চড়িয়ে রাতে বাথানে ফেরেন তারা।
রাজশাহী জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ড. জুলফিকার মো. আখতার হোসেন বলেন, রাজশাহীর পদ্মায় চরখিদিরপুর ও চর মাঝারদিয়ারে গবাদিপশু পালন হয়ে থাকে। এর মধ্যে চর মাঝারদিয়ারে গরু রয়েছে ৪ হাজার ৩৩৫টি, মহিষ ১ হাজার ২০৫টি, ভেড়া ১ হাজার ৩৫টি, ছাগল ৭ হাজার, হাঁস ২ হাজার ১০০ ও মুরগি ৫ হাজার ৭৫১টি। এছাড়া চরখিদিরপুরে গরু রয়েছে ৪ হাজার ৫৬১টি, মহিষ ৪০৫টি, ভেড়া ১ হাজার ৫১টি, ছাগল ৬ হাজার ১১৩টি, হাঁস ২ হাজার ২১৮ ও মুরগি ৫ হাজার ৭৭৫টি।
রাজশাহী অঞ্চলের পদ্মায় জেগে ওঠা চরের একটা বড় অংশ পড়েছে পবা উপজেলার মধ্যে। এই উপজেলার ছয় নম্বর হরিয়ান ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মফিদুল ইসলাম বাচ্চু বলেন, চরের মানুষ মূলত গরু-ছাগল পালন করে থাকেন। তাদের অর্থনৈতিক অবস্থা মোটামোটি ভালো। তবে যারা মাদক ব্যবসা করে তাদের অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো না। এমন ১০ থেকে ১২ জন রয়েছেন। এছাড়া অনেকেই মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করে থাকেন। এখন নদীতে বেশি পানি নেই। তবে, কিছু কিছু জায়গায় পানি রয়েছে। সেই সব জায়গায় মাছ হয়।
পবা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) লসমী চাকমা বলেন, চরের মানুষ মূলত বেশি কৃষি কাজ করেন। তাদের জন্য সরকারিভাবে বিভিন্ন সময় প্রণোদনা দেওয়া হয়ে থাকে। এছাড়া গবাদিপশুও পালন করে থাকেন তারা।-সূত্র: ঢাকা পোস্ট
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের জিওগ্রাফি এন্ড এনভায়রনমেন্ট স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. মিজানুর রহমান বলেন, পদ্মা নদী অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ নদী। পদ্মাকে বাঁচানো খুব জরুরি। নদী ভরাট ও দূষণে মাছসহ অন্যান্য জীবের স্বাভাবিক জীবনপ্রবাহ নষ্ট হচ্ছে। নদীতে চর পড়ে যাওয়ায় মাছের উৎপাদন কমে গেছে। ইতোমধ্যেই নদীগুলো হতে অনেক মাছ বিলুপ্ত হয়েছে। মানুষকে আরও সচেতন হতে হবে। নদী বাঁচাতে এগিয়ে আসতে হবে সবাইকে।