২০১৭ সালে কালি ও কলম পত্রিকায় এক প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছিল ‘রফিক আজাদের কবিতায় “গোলাপ”’ শিরোনামে। প্রবন্ধকার মুনীর সিরাজ এক জায়গায় লিখেছিলেন, ‘…কবি শামসুর রাহমানকে বলতে শুনেছিলাম “আ রোজ ইজ আ রোজ ইজ আ রোজ’, গোলাপই কেবল গোলাপের প্রতীক হতে পারে।’
প্রবন্ধটি পড়ার পর ঘাঁটাঘাঁটি করে দেখা গেল, কবি শামসুর রাহমানের বলা ওই উদ্ধৃতি এসেছে মার্কিন সাহিত্যিক গ্রারট্রুড স্টেইনের ‘সেকরেড এমিলি’ কবিতা থেকে। স্টেইনের কবিতার পঙ্ক্তির বিশদ ব্যাখ্যা আছে, তবে তা নিয়ে আর কথা বাড়ানোর প্রয়োজন দেখছি না। কারণ, আমাদের বিষয় কেবলই গোলাপ এবং ভালোবাসা দিবস।
গোলাপকে বলা হয় ফুলের রানি। এই উপমা একেবারে আধুনিক কালের নয় কিন্তু। ৬০০ খ্রিষ্টপূর্ব গ্রিক কবি স্যাফো গোলাপ প্রসঙ্গে বলেছিলেন, ‘আ কুইন ফর অল দেয়ার ওয়ার্ল্ড অব ফ্লাওয়ারস, দ্য রোজ উড বি দ্য চয়েস…।’
ঝরে পরা গোলাপের ঘ্রাণও যে কতটা মধুর, সে কথা মনে করিয়ে দেন স্বয়ং শেক্সপিয়ার, ‘অব দেয়ার সুইট ডেথস আর সুইটেস্ট ওডার মেড…।’
কবি-সাহিত্যিকদের গোলাপ–কীর্তনের শেষ উদাহরণটি দিই কবি রফিক আজাদের কবিতা থেকে, ‘ফেলে রেখে গিয়েছিলে ভুলে/ খোঁপার গোলাপ/ সারা রাত জেগে আমি পাহারা দিয়েছি/ তোমার সৌরভ…।’
আজ ভালোবাসা দিবস। প্রিয়জনকে কী উপহার দেবেন, জানি না। তবে জেনে রাখুন, ২০১৪ সালের এক জরিপে দেখা গেছে, প্রতিবছর ফেব্রুয়ারির ১৪ তারিখে যত ফুল উপহার দেওয়া হয়, তার মধ্যে গোলাপ থাকে ৮৮ শতাংশ! আর সব মিলিয়ে সারা বিশ্বে ভালোবাসা দিবসে গোলাপ ফুল বিক্রি হয় ২৫ কোটি! অর্থাৎ গোলাপ বা লাল গোলাপ যে ভালোবাসা দিবসের প্রতীক হয়ে উঠেছে, এ নিয়ে কারও দ্বিমত নেই। কিন্তু লাল গোলাপ কীভাবে ভালোবাসা দিবসের অন্যতম প্রতীক হয়ে উঠল?
লোককাহিনি থেকে বাস্তবে
যুক্তরাজ্যভিত্তিক ফ্লাইং ফ্লাওয়ারস নামের এক ফুল বিক্রেতা প্রতিষ্ঠানে এক দশকের বেশি বিপণনের অভিজ্ঞতা আছে স্যান্ড্রা ভার্লের। তিনি বলেন, ‘ভালোবাসার দীর্ঘস্থায়ী নিদর্শন হিসেবে গাছ খুব ভালো একটা উপহার এবং গোলাপের গাছ এ ক্ষেত্রে দারুণ জনপ্রিয়। একগুচ্ছ গোলাপ হয়তো গাছের মতো অতটা দীর্ঘস্থায়ী হয় না, কিন্তু তারপরও ফুলগুলো যতক্ষণ তাজা থাকে, ততক্ষণই প্রিয় মানুষের ভালোবাসার উষ্ণতা ছড়ায়।’
ভালোবাসা দিবসের সঙ্গে গোলাপের সম্পর্ক নিয়ে অনেকগুলো লোককাহিনি প্রচলিত আছে। অনেকেই মনে করেন, এর উৎস গ্রিক লোককাহিনি থেকে। এক লোককাহিনিতে বলা হয়েছে, একটি সাদা গোলাপের কাঁটার আঁচড়ে গ্রিক প্রেমের দেবী আফ্রোদিতির শরীর থেকে রক্ত ঝরেছিল। সেই রক্তে সাদা গোলাপ হয়ে উঠেছিল লাল। আরেকটি কাহিনি অনুসারে, আফ্রোদিতির প্রেমিক অ্যাডোনিসের মৃত্যুর পর আফ্রোদিতি যেখানে অশ্রু বিসর্জন দেন, সেখানেই প্রথম লাল গোলাপের জন্ম।
ভুল থেকে ভালোবাসার ফুল
এ তো গেল লোককাহিনির কথা। বাস্তব জীবনে লাল গোলাপের সঙ্গে ভালোবাসা বা রোমান্সের প্রথম যোগসূত্র তৈরি করেন সতেরো শতকে তুরস্কে নিযুক্ত ব্রিটিশ রাষ্ট্রদূতের স্ত্রী লেডি মেরি মন্টাগু। তিনি চিঠি লেখার সময় তুরস্কে প্রচলিত ‘ফ্লাওয়ার ল্যাঙ্গুয়েজ’ অনুসরণ করতেন। ফ্লাওয়ার ল্যাঙ্গুয়েজে বিভিন্ন ফুল দিয়ে বিভিন্ন প্রতীকী অর্থ বোঝানো হতো।
কিন্তু লেডি মেরি মন্টাগু সম্ভবত স্থানীয় ওই রীতির ভুল ব্যাখ্যাটি বুঝেছিলেন। চিঠিতে ফুলের নাম ব্যবহার করা হতো মূলত ছন্দ মেলানোর জন্য, নির্দিষ্ট কোনো ফুলের গুরুত্ব বোঝানোর জন্য নয়।
তারপরও ওই ফ্লাওয়ার ল্যাঙ্গুয়েজ অনেকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। বিশেষ করে ইংল্যান্ডে ঊনবিংশ শতাব্দীতে তা ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়। পরবর্তী সময়ে রোমান্টিক প্রেমের সম্পর্কের প্রতীক হিসেবে গোলাপ আরও প্রতিষ্ঠিত হতে থাকে।
আরও কিছু কারণ
বিশেষজ্ঞদের মতে, ভালোবাসা দিবসের সঙ্গে গোলাপের সম্পর্ক দিন দিন আরও গভীর হওয়ার পেছনে আরও কিছু কারণ আছে। যেমন গোলাপ সুন্দর, এর ঘ্রাণ মোহনীয় এবং এই ফুলের সরবরাহব্যবস্থাও বেশ সহজ। বিপণনের সময় লাখ লাখ ফুল পাড়ি দেয় দীর্ঘ পথ।
এ ক্ষেত্রে গোলাপ ফুলের প্রাণশক্তি অন্য সব ফুলের চেয়ে বেশি। প্রাণশক্তিময়, সুন্দর ও সুঘ্রাণ—ভালোবাসার সব গুণই আদতে আছে গোলাপে। অতএব ভালোবাসা দিবসে লাল গোলাপই যে অপ্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠবে, এ তো সহজ হিসাব! সবাইকে ভালোবাসা দিবসের লাল গোলাপ শুভেচ্ছা!