ঢাকামঙ্গলবার , ৫ এপ্রিল ২০২২
  • অন্যান্য

বাংলাদেশি অভিবাসীরা ইতালি যেতে কেন অবৈধ পথ বেছে নেয়?

এপ্রিল ৫, ২০২২ ১১:০৪ পূর্বাহ্ণ । ১৩৪ জন

অবৈধপথে প্রায় ৯ হাজার বাংলাদেশি গেল বছর ইইউভুক্ত দেশে গিয়েছেন। তাদের সিংহভাগেরই চূড়ান্ত গন্তব্য ছিল—ইতালি বিপজ্জনক সমুদ্র, অবৈধ যাত্রা— বেশিরভাগের লক্ষ্য ইউরোপের মাটিতে কাজের সন্ধান। ইনফো মাইগ্রেন্ট নামক সংবাদ মাধ্যমে সেকথাই জানান বাংলাদেশি অভিবাসী যুবক লোকিউরা সবুজ। তিনি বলেন, “কয়েক বছর আগে আমার বাবা মারা যান, তখন লিবিয়া যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেই। ৮ সদস্যের পরিবারে আমিই তখন একমাত্র উপার্জনক্ষম, সংসারের জন্য একটা কিছু করতেই হতো।”

গেল বছর ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইতালি আসেন ২৫ বছরের এ বাংলাদেশি যুবক। তার আগে ৪ হাজার ইউরো বা প্রায় ৩ লাখ ৯৩ হাজার টাকা খরচ করে লিবিয়া যান সবুজ। সেখানেই ছিল তার প্রাথমিক কর্মস্থল। সে সময়ে তিনি ইউরোপে পাড়ি জমানোর চিন্তাও করেননি।

লিবিয়া আসার খরচ যোগাড় করতে তার দরিদ্র পরিবারের কষ্টের কথা তুলে ধরে বলেন, “আমরা খুব গরিব। শরীয়তপুর জেলায় আমাদের বাড়ি। মা গ্রামেই বাসাবাড়িতে ঝিয়ের কাজ করেন। লিবিয়া আসার জন্য গরু বিক্রি করেছি, কিছু টাকাও ধারকর্জ করতে হয়েছে।”

দারিদ্র্যের কারণেই ছোটবেলায় স্কুলে যাওয়ার সুযোগ পাননি সবুজ। লিবিয়া এসে তিনি দেশটির বেনগাজি শহরে কয়েক মাস নির্মাণ কর্মীর কাজ করেন। তবে একদিন মজুরি চাইলে তাকে মারপিট করা হয়। এই অবস্থায় দুটো টাকা উপার্জনের আশাতেই নৌকায় বিপজ্জনক সমুদ্রযাত্রা করে ইতালি যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।

সমুদ্রযাত্রা: 

দালাল ও আদম পাচারকারীদের সংঘবদ্ধ চক্র শরণার্থী, অভিবাসন প্রত্যাশী এবং ইউরোপের কাজের সন্ধান করা মানুষকে ছোট নৌযানে করে ইতালিতে আনে। এভাবে সমুদ্রযাত্রায় থাকে মারাত্মক প্রাণের ঝুঁকি। প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনা ও মৃত্যুর ঘটনা হচ্ছে সংবাদ শিরোনাম।

নিজ অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন সবুজও। তিনি জানান, প্রায় ২৪ ঘণ্টা ধরে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ২০২১ সালের ২১ ফেব্রুয়ারিতে ইতালির ল্যাম্পেডুসা দ্বীপে পৌঁছায় আমাদের নৌকাটি। যাত্রী ছিল ৯৩ জন, আমিসহ তারমধ্যে ৪০ জনই বাংলাদেশি।”

ইতালি আসার পর থেকেই দেশটির রাজধানী রোমের অভিবাসী কেন্দ্রে রয়েছেন সবুজ। ইউরোপের দেশটিতে তার কাজ করার স্বপ্ন আজো অধরা।

“ইতালি আনতে লিবিয়ায় দালালকে আরও ২ হাজার ইউরো দিয়েছি… অথচ আমি এখনও বেকার। এখানে কাউকে চিনি না। কেউ আমাকে চাকরির প্রস্তাবও দেয়নি। দেশে মা আছেন, এখনও তাকে বাড়ি বাড়ি কাজ করে সংসার চালাতে হচ্ছে। আমার জন্য ভবিষ্যতে কী অপেক্ষা করছে- তাও জানি না।”

ইতালিতে বাংলাদেশি অভিবাসীর সংখ্যা প্রায় দেড় লাখ। ছবি: ডয়চে ভেলে

আসছেন হাজারো মানুষ:

৪০৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের জিডিপি নিয়ে বিশ্বের ৩৭তম বড় অর্থনীতি বাংলাদেশের। বিভিন্ন সংস্থার পূর্বাভাস অনুযায়ী, ২০৩০ সাল নাগাদ এদেশের অর্থনীতি দ্বিগুণ হবে।

দক্ষিণ এশিয়াসহ পুরো বিশ্বের অন্যতম দ্রুত বিকাশমান অর্থনীতি হওয়ার পরও বাংলাদেশের হাজার হাজার নাগরিক উন্নত ও নিরাপদ ভবিষ্যতের আশায় অবৈধপথে ইউরোপ যাওয়ার চেষ্টা করেন।

ইউরোপীয় ইউনিয়নের বর্ডার এজেন্সি- ফ্রন্টেক্স প্রকাশিত পরিসংখ্যান অনুযায়ী, শুধু গত বছরেই ৮ হাজার ৬৬৭ বাংলাদেশি অবৈধভাবে ইইউভুক্ত দেশগুলোতে এসেছে। এদের মধ্যে আবার ৭ হাজার ৫৭৪ জন কেন্দ্রীয় ভূমধ্যসাগরের রুট দিয়ে আর ৬০৪ জন গিয়েছেন পূর্ব ভূমধ্যসাগর রুট দিয়ে। আরও ৪৩৭ জন বলকান অঞ্চলের স্থলসীমা দিয়ে গেছেন।

লিবিয়া থেকে ইতালি যাওয়ার কেন্দ্রীয় ভূমধ্যসাগরের রুটটি সবচেয়ে বিপজ্জনক। যেসব দেশের অভিবাসীরা এ পথে আসছেন- তারমধ্যে ফ্রন্টেক্সের তালিকায় দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে বাংলাদেশ।

গত মাসেই প্রচণ্ড শীতে জমে নৌকায় মারা যান আরোহী ৭ বাংলাদেশি। নৌকাটি ইতালির ল্যাম্পেডুসা পৌঁছানোর চেষ্টা করছিল। এই রুটে এমন প্রাণহানি নিয়মিত ঘটছে।

ইতালি অভিবাসীদের সবচেয়ে পছন্দের গন্তব্য:

যে পথেই আসুক না কেন শেষমেষ বেশিরভাগ বাংলাদেশি অভিবাসী ইতালিতেই আসে- বলে জানিয়েছে ফ্রন্টেক্স পরিসংখ্যান। গেল কয়েক দশক ধরেই ইউরোপে আসা বেশিরভাগ বাংলাদেশির কাছে জনপ্রিয় হলো—ইতালি।

গেল বছর সার্বিয়ায় মেয়াদি কর্মী ভিসা নিয়ে এসেছেন বাংলাদেশি অভিবাসী আরাফাত রহমান। তিনি ইনফো মাইগ্রেন্টস’কে জানান, ইতালিই তার চূড়ান্ত গন্তব্য।

“সার্বিয়া থেকে ইতালি যেতে এরমধ্যেই হাজার হাজার ইউরো খরচ করেছি। খুব শিগগির সেদেশে যাওয়ার আশা করছি।”

আরাফাত জানান, সার্বিয়ায় বসবাসকারী বাংলাদেশি দালালেরা ইতালিতে কাউকে পাচার করে নিয়ে যেতে ৪ থেকে ৬ হাজার ইউরো দাবি করে।  ”

“যাত্রার সবচেয়ে নিরাপদ উপায় সার্বিয়া থেকে ইতালিগামী কোনো লরিতে লুকিয়ে যাওয়া। কিন্তু সেজন্য পাচারকারীদের অনেক বেশি টাকা দিতে হয়। আরেকটি উপায় হলো পায়ে হেঁটে সীমান্ত পাড়ি দেয়, এতে খরচ কম হলেও—ঝুঁকি অনেক বেশি।”

আরাফাত অবৈধপথে ইতালি যেতে পারেননি। এক আদম পাচারকারী তার টাকাপয়সা কেড়ে নেয়, স্থানীয় পুলিশকে জানালে হত্যার হুমকিও দেয়। তারপর থেকেই সার্বিয়ার একটি অভিবাসী কেন্দ্রে থাকছেন বিদেশ-বিভূঁইয়ে কপর্দকশূন্য এ যুবক।

আরাফাত বলেন, “বাংলাদেশের একটি আদালতে কম্পিউটার অপারেটর হিসেবে চাকরি পেতে ব্যর্থ হওয়ার পর ইতালি যাওয়ার স্বপ্ন নিয়ে সার্বিয়া এসেছিলাম।” তিনি জানান ওই চাকরি পেলে তার মাসিক বেতন হতো ১৬০ ইউরো বা ১৬ হাজার টাকা; কিন্তু সেজন্য তার কাছে প্রায় ১৬ লাখ টাকা ঘুষ দাবি করা হয়।

“এত টাকা দেওয়ার সামর্থ্য না থাকায় ওই চাকরি না নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেই। ভেবেছিলাম তার চেয়ে ইতালি গেলে বেশি উপার্জন করতে পারব। ইতালি আসতে যে ঋণ করেছি দেশে টাকা পাঠিয়ে তাও শোধ করতে পারব।”

ইতালি-ই কেন? 

“ইতালিতে প্রায় দেড় লাখ বাংলাদেশি অভিবাসী রয়েছেন। কৃষি, জাহাজ নির্মাণ ও সড়কে পণ্য বিকিকিনিসহ তারা নানান খাতে কাজ করছেন”- বলে ইনফো মাইগ্রেন্টস’কে জানান দেশটিতে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত শামীম আহসান।

ইউভুক্ত অন্য কোনো দেশে এত বাংলাদেশি অভিবাসী নেই। এই কূটনীতিক মনে করেন, বিদেশিদের প্রতি ইতালির মানুষের সহৃদয় মনোভাব বেশি। তাছাড়া, প্রায়ই অস্থায়ী অভিবাসী শ্রমিকদের বৈধতা দেয় দেশটি।

তিনি ব্যাখ্যা করে বলেন, “ইতালি বিদেশিদের প্রতি সদয় এমন একটি প্রচলিত ধারণা রয়েছে। একারণেই যেপথেই আসুক না কেন একবার দেশটিতে গেলেই একসময় বৈধতা পাবে বলে মনে করেন অনেকে।”

নেই কোনো বৈধ রুট:  

২০২০ সাল থেকে ‘মৌসুমি’ ও ‘অমৌসুমি’ এই দুই ক্যাটাগরিতে বাংলাদেশি কর্মী নিয়োগদানের নিয়ম করেছে ইতালি সরকার।

গেল মাসে রোমে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাসের বিতরণ করা ইতালি সরকারের এক প্রজ্ঞাপনে জানানো হয়, ‘ইতালি বাংলাদেশ-সহ ৩১টি ইইউ বহির্ভূত দেশের জন্য ৬৯ হাজার ৭০০ ভিসা ইস্যু করবে।

শামীম আহসান বলেন, ‘ইতালি আসতে ইচ্ছুক বাংলাদেশিদের বৈধভাবেই আসা উচিত।” আরেকটি কারণ হিসেবে তিনি ইইউ এর সাথে বাংলাদেশ সরকারের একটি প্রত্যাবাসন চুক্তির কথা উল্লেখ করেন। এর আওতায় অবৈধ বলে চিহ্নিত অভিবাসীদের দ্রুত বাংলাদেশে ফেরত পাঠাতে পারবে ইতালি সরকার।

তবে ইতালিতে বৈধভাবে যাওয়া সহজ নয়।

“এদেশে লাখ লাখ মানুষ আসতে চায়। সে তুলনায় ওই প্রজ্ঞাপনের আওতায় কেবল সাড়ে তিন হাজার বাংলাদেশি ভিসা পাবে”- বলে জানান ভেনিস শহরের অধিবাসী বাংলাদেশি সাংবাদিক পলাশ রহমান।

তার মতে, “বাংলাদেশি শ্রমিকদের বৈধভাবে আসার সুযোগ বৃদ্ধি করতে হবে।” নাহলে অবৈধ অভিবাসন নিয়ন্ত্রণ কঠিন হবে এমন ইঙ্গিতই দেন তিনি।


  • সূত্র: ডয়চে ভেলে