ঢাকাবুধবার , ১ মার্চ ২০২৩
  • অন্যান্য

রাজশাহীর অর্থনীতি চাঙ্গা রেখেছে পান

মার্চ ১, ২০২৩ ১১:৫১ পূর্বাহ্ণ । ৩৩৯ জন

নিজস্ব প্রতিবেদক:

রাজশাহীতে তিন ধরনের পানের চাষ হয়। এরমধ্যে দুধস্বর সাচি পান, মিষ্টি পান ও সাচি পান। এই পান গ্রামীণ অর্থনীতি চাঙ্গা রেখেছে পান। রাজশাহীর মোহনপুর, দুর্গাপুর, বাগমারা উপজেলার সিংহভাগ জমিতেই রয়েছে পানের বরজ। ফলে এই অঞ্চলের কৃষক, চাষী বা ব্যবসায়ীদের জীবিকার একমাত্র চালিকা শক্তি পান। বরজ থেকে চাষিরা সরাসরি ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করেন পান। স্থানীয় হাটে-বাজারে বেচাকেনায় সুবিধা থাকায় অন্য ফসলের তুলনায় অধিক লাভজনক পানের চাষাবাদ। এই জেলার নয়টি উপজেলাতেই রয়েছে পানের বরজ।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ২০২১-২২ অর্থবছরের তুলনায় চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরে ১৩৫ হেক্টর জমিতে পানের চাষাবাদ বেড়েছে। মোহনপুর, বাগমারা ও দুর্গাপুরের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের জীবন-জীবিকা পান ও পানের বরজকে ঘিরে। এইসব উপজেলায় পানের বরজ নেই; এই রকম মানুষ খুব কম রয়েছে।

রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, ২০২১-২২ অর্থবছরের পানের চাষ হয়েছিল ৪ হাজার ৩৬১ হেক্টর জমিতে। যার গড় ফল ছিল ১৬ দশমিক ৯১ মেট্রিক টন। উপাদন হয়েছিল ৭৩ হাজার ৭৭১ দশমিক ২ মেট্রিক টন। এছাড়া কৃষকের সংখ্যা ৩৭ হাজার ৯৩২ জন। পানের বরজ ছিল ৩৮ হাজার ৯০৬টি। আর চলতি বছরে পানের চাষ হয়েছে ৪ হাজার ৪৯৬ হেক্টর জমিতে। যার গড় ফল ছিল ১৭ দশমিক ০৫ মেট্রিক টন। সম্ভাব্য উপাদন ৭৬ হাজার ৬৭৮ দশমিক ৩৮ মেট্রিক টন। এছাড়া কৃষকের সংখ্যা ৩৮ হাজার ৯০০ জন। পানের বরজ রয়েছে ৩৯ হাজার ৬৭৪টি। এছাড়া একবিঘায় ১ লাখ ৮৫ হাজার টাকার পান বিক্রি করে চাষী। তাহলে ৪ হাজার ৪৯৬ হেক্টর পানে দাম পড়ে প্রায় ৬২৩ কোটি ৮২ লাখ টাকা।

জেলার মোহনপুরের ঘোপাঘাটা, মৌগাছি, কেশরহাটের পান বাজারে ক্রেতা-বিক্রেতাদের সাথে কথা হলে তারা জানায়, পানের দাম বর্তমান সময়ে বেশি। প্রতিবছর এই সময়ে পানের দাম বেশি থাকে। বর্তমানে বড়-ছোট আকৃতি অনুযায়ী প্রতি পোয়া (৩২ বিড়া) পানের দাম দেড় হাজার টাকা থেকে ৩ হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে। যার মধ্যে ছোট পান বিক্রি হচ্ছে ১২ শো টাকা, মাঝারি ২ হাজার টাকা থেকে ২৮ শো টাকা এবং মোটা বা বড় পান সাড়ে ৩ হাজার থেকে ৫ হাজার টাকা পোয়া দরে।

ষাটোর্ধ্ব আব্দুর রাজ্জাক বলেন, আমাদের মোহনপুরে ভিটা বা উঁচু জমি একটাও ফাঁকা পাওয়া যাবে না। মোট কথায় যে জমিতে পানের চাষাবাদ করা সম্ভব, সেই জমিতে পান ছাড়া অন্য চাষাবাদ করা হয় না। কারণ পানে খরচও কম আর সবসময় টাকা পাওয়া যায়। চাষী বা কৃষকের টাকার দরকার হলে বরজ থেকে পান তুলে হাটে বিক্রি করে। বিক্রিতে কোন তৃতীয় পক্ষ বা দালাল ধরতে হয় না। ফলে হাতে হাতে নগদ টাকা পান চাষীরা। এই মোহনপুরে সপ্তার প্রতিদিনই কোন না কোন হাট বসে। এই অঞ্চলের মানুষ পান বিক্রির টাকাকে ‘কাঁচা টাকা’ বলে থাকে। বর্তমানের পানের দাম বেশি। বছরের শুধু এই সময়ে পানের দাম বেশি থাকে। এখন ৫ হাজার থেকে সাড়ে ৫ হাজার টাকা পোয়া পান বিক্রি হচ্ছে। আর বিড়ার হিসেবে ১৫০ থেকে ১৯০ টাকা।

উপজেলার কইকুড়ি বাজার এলাকার পানচাষী শাহাদাৎ হোসেন বলেন, পানের বরজ সন্তানের মতো যতœ করতে হয়। যত্ন না করলে পানের বরজ ভালো হয় না। কোন কাজ না থাকলেও দিনে একবার হলেও আসতে হবে পানের বরজে। প্রতিবছর এই সময়ে পানের দাম বেশি থাকে। কৃষকরা পান বিক্রি করে অন্য ফসল ফলায়। এই অঞ্চলের বেশির ভাগ মানুষ জমিতে সরিষা ছিল। তাদের মধ্যে কেউ সরিষা কেটে ঘরে তুলেছেন। আবার কারো জমিতে সরিষা রয়েছে। এই জমিতে সবাই ধান চাষ করবেন। কৃষকরা ধান চাষের খরচ চলবে পান বিক্রির টাকা দিয়ে। আর সরিষার দাম বেশি হলে কৃষকরা তখন বিক্রি করবেন। ভাল পান হলে ১০ কাঠার বরজ থেকে বছরে লাখ টাকার পান বিক্রি করা সম্ভব। এই অঞ্চলে একেক পরিবারে তিন থেকে চরটি করে পানের বরজ রয়েছে। এছাড়া যান নেই, তারও একটা পানের বরজ রয়েছে।

পান ব্যবসায়ী আশরাফুল ইসলাম জানান, মোহনপুরে ধোপাঘাটায় সপ্তায় পাঁচদিন হাট বসে। একই ভাবে দুর্গাপুরের দাওকান্দিতে সপ্তায় পাঁচদিন হাট বসে। এই হাটগুলোতে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত পাস কেনা-বেচা চলে। রোববার (১৯ ফেব্রুয়ারি) বাগমারার দাওকান্দি হাটে পান বিক্রি হচ্ছে এখন ৫ হাজার থেকে সাড়ে ৫ হাজার টাকা পোয়া। আর বিড়ার হিসেবে ১৫০ থেকে ১৯০ টাকা। তিনি ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ট্রাকে পান পাঠান।

মোহনপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা রহিমা খাতুন বলেন, জেলার মোহনপুর উপজেলায় সবচেয়ে বেশি পানের চাষাবাদ হয়। এই উপজেলায় স্বাদে মিষ্টি পান চাষাবাদ হয়। রাজশাহীর মোহনপুরে সপ্তার প্রতিদিনই প্রায় হাট বসে। ধোপাঘাটা, একদিলতলা, মৌগাছি, কেশরহাটসহ কয়েকটি হাটে পান বিক্রি করে চাষীরা। এসব হাটগুলোতে সপ্তাহের ভিন্ন ভিন্ন দিনে বসে। স্থানীয় বাজারে পান বিক্রি হয় পোয়ার (৩২ বিড়ায় এক পোয়া) হিসেবে।

তিনি আরো বলেন, এবছর ১ হাজার ৩১৭ হেক্টর জমিতে পানের চাষাবাদ হয়েছে। যার সম্ভাব্য গড় ফলন ধরা হয়েছে ১৬ মেট্রিক টন। সম্ভাব্য উৎপাদন ২১ হাজার ৭২ মেট্রিক টন। কৃষকের সংখ্যা ১৭ হাজার ৮৫০ জন। পানের বরজ আছে ১৯ হাজার ৮৫৫ টি। আমরা কেজিতে পানের দাম নির্ধারণের পদ্ধতি বের করেছি। আমরা পর্যালোচনা করে দেখেছি- একটি পানের গড় ওজন ৫ গ্রাম। আর এক পোয়া বা ৩২ বিড়া পানের ওজন ১০ কেজি। এছাড়া একবিঘায় ১ লাখ ৮৫ হাজার টাকার পান বিক্রি করে চাষী।
রাজশাহী জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত উপ-পরিচালক শারমিন সুলতানা বলেন, রাজশাহীজুড়ে পানের চাষাবাদ হচ্ছে। এই জেলার সব উপজেলায় কম বেশি পানের চাষ হচ্ছে। তারমধ্যে সবচেয়ে বেশি মোহনপুরে। এই উপজেলায় নিচু বা ডোবা ছাড়া সব জমিতেই পানের চাষ হয়।

উদাহারণ হিসেবে এই কর্মকর্তা বলেন, পান এমন একধরনের ফসল যা চাকরির মতো বেতন দেয়। একজন চাষী মাসে তিন-চার বার পান বরজ থেকে তুলে হাটে বিক্রি করেন। এছাড়া আপদ-বিপদেও দ্রুত টাকা পাওয়া যায় পান বিক্রি করে। পানকে সাধারণত ‘লিকুইট মানি’ বলা হয়।